বিতর্ক কত প্রকার ও কি কি : আমরা অনেকেই বিতর্ক নিয়ে কম-বেশি ধারণা রাখি। স্কুল-কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অনেকেই সরাসরিভাবেই বিতর্কের সাথে সম্পৃক্ত থাকেন। বিতর্ক হচ্ছে যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে নিজের মতামত প্রতিষ্ঠা করা। একটি নির্ধারিত বিষয়ের পক্ষে-বিপক্ষে নিজের যুক্তি উপস্থাপনের মাধ্যমে নিজের বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠিত করাই বিতর্কের মূল উদ্দেশ্য।বিতর্কের মাধ্যমে নিজের বলার ও জানার দক্ষতা বৃদ্ধি পায়।
বিতর্ক কত প্রকার ও কি কি !
বিতর্ক হচ্ছে যুক্তি-তর্কের খেলা। বিতর্কের মাধ্যমে যুক্তির আয়নার নিজের ভাবনাগুলোকে প্রতিফলিত করা যায়। এর ফলে বাড়ে চিন্তার পরিধি, জ্ঞান আর প্রতিপক্ষের প্রতি সম্মান।
বিতর্কে সাধারণত ২ শ্রেনির হয়ে থাকে।
১.প্রদর্শনী বিতর্ক
- প্রদর্শনী বিতর্কের মাঝে রম্য বিতর্ক, আঞ্চলিক বিতর্ক, প্ল্যানচ্যাট বিতর্ক, জুটি বিতর্ক এইগুলা বিদ্যমান।
২.প্রতিযোগিতামূলক
প্রতিযোগিতামূলক বিতর্কের মাঝে সংসদীয় বিতর্ক, সনাতনী বিতর্ক, বারোয়ারি বিতর্ক ইত্যাদি প্রচলিত রয়েছে। এ ছাড়াও ইংরেজি বিতর্কের ঘরানার মাঝে ব্রিটিশ পার্লামেন্টরি বিতর্ক বর্তমানে বিশ্বজুড়ে ব্যাপক জনপ্রিয়। ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটিস ডিবেটিং চ্যাম্পিয়নশিপ বা রাউন্ড রবিনের মতো আন্তর্জাতিক ডিবেট টুর্নামেন্টগুলো মূলত ব্রিটিশ পার্লামেন্টরি ফরম্যাটেই হয়ে থাকে।
আসুন জেনে নেই বিস্তারিতভাবেঃ
সনাতনী বিতর্ক:
বিতর্কের বেশ প্রাচীনকালীন এ ফরম্যাটটি বর্তমানে খুব একটি প্রচলিত না থাকলেও বাংলাদেশের জাতীয় টেলিভিশন বিতর্ক বা স্কুল পর্যায়ের বিতর্কগুলো এখনো সনাতনী পদ্ধতিতে করা হয়ে থাকে। বিতর্কের এ ধারায় ব্যাকরণিক জটিলতা অন্য যেকোনো ফরম্যাটের বিতর্ক থেকে যথেষ্ট কম। এখানে একটি নির্ধারিত বিষয়ের উপর পক্ষ দলের ও বিপক্ষ দলের তিনজন বক্তা (১ম বক্তা, ২য় বক্তা ও দলনেতা) পালাক্রমে নিজেদের বক্তব্য উপস্থাপন করেন। সনাতনী বিতর্কে সাধারণত প্রত্যেক বক্তা তার বক্তব্য উপস্থাপনের জন্যে পাঁচ মিনিট ও গঠনমূলক পর্বের বক্তব্য শেষে উভয় পক্ষের দলনেতারা যুক্তিখন্ডনের জন্যে অতিরিক্ত তিন মিনিট করে সময় পেয়ে থাকেন। সনাতনী বিতর্ক পরিচালনার দায়িত্বে যিনি থাকেন তাকে ‘সভাপতি’ বা ‘মডারেটর’ হিসেবে সম্বোধন করা হয়ে থাকে। বর্তমানে এর প্রচলন কমে গেলেও বিতর্কের হাতেখড়ির জন্যে সনাতনী বিতর্ক যথার্থ।
সংসদীয় বিতর্ক:
সংসদীয় বিতর্ক হচ্ছে হালের জনপ্রিয় ডিবেট ফরম্যাট। বর্তমান সময়ে প্রতিযোগিতামূলক বিতর্কের ক্ষেত্রে সংসদীয় বিতর্কের ব্যবহার সর্বাধিক হারে দেখা যায়। তবে সনাতনী বিতর্কের তুলনার এ বিতর্ক ব্যাকরণগতভাবে বেশ জটিল। উভয় পক্ষের বক্তাদের (প্রধানমন্ত্রী/বিরোধীদলীয় নেতা, মন্ত্রী/উপনেতা, সংসদ সদস্য) প্রত্যেকে এখানেও পাঁচ মিনিট করে সময় পান তাদের বক্তব্য উপস্থাপনের জন্যে, কিন্তু এই পাঁচ মিনিট সময়ের মাঝে কৌশলগতভাবে প্রতিপক্ষ দল পয়েন্ট অফ ইনফরমেশন, পয়েন্ট অফ অর্ডার বা পয়েন্ট অফ প্রিভিলেজের মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে আঘাত হানার পাশাপাশি নিজেদের জন্যে সুবিধা আদায় করে নিতে পারেন। গঠনমূলক পর্ব শেষে যুক্তিখন্ডন পর্বে প্রথমে বিরোধীদলীয় নেতা ও সর্বশেষে প্রধানমন্ত্রী তিন মিনিট করে অতিরিক্ত সময় পেয়ে থাকেন। ফরম্যাটের নামই যেহেতু সংসদীয় বিতর্ক, সুতরাং স্বাভাভিকভাবেই পুরো বিতর্কটি যিনি পরিচালনা করবেন তাকে ‘স্পিকার’ হিসেবে সম্বোধন করা হবে।
ব্রিটিশ পার্লামেন্টরি বিতর্ক:
এ বিতর্কটি বেশ জটিল ধরনের। মূলত ইংরেজি বিতর্কের ক্ষেত্রে এ ফরম্যাটটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে বিধায় আমাদের দেশে এ ফরম্যাটের সাথে অনেকেই পরিচিত না। তবে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ইংরেজি বিতর্কের ক্ষেত্রে নিয়মিত চর্চার পাশাপাশি বর্তমানে এ ফরম্যাটটিকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে বর্তমানে ‘বাংলা বিপি বিতর্ক’ এর বেশ প্রচলন দেখা যাচ্ছে।
এ ফরম্যাটটি মূলত ব্রিটেনের সংসদীয় পদ্ধতির অনুসরণে করা। ব্রিটেনের সংসদে যেমন হাউজ অফ লর্ডস আর হাউজ অফ কমন্স নামে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদীয় পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে, একইভাবে বিপি বিতর্কেও উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষ আলাদা আলাদাভাবে থাকে। সুতরাং, মোট চারটি দল নিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টরি বিতর্ক হয়ে থাকে। চারটি দল হচ্ছে সরকারদলীয় উচ্চকক্ষ, বিরোধীদলীয় উচ্চকক্ষ, সরকারদলীয় নিম্নকক্ষ ও বিরোধীদলীয় নিম্নকক্ষ।
ব্রিটিশ পার্লামেন্টরি বিতর্কের ক্ষেত্রে বক্তারা সাধারণত সাত মিনিট করে সময় পান বক্তব্য দেয়ার জন্যে। তবে এ বিতর্কে কোনো ধরনের যুক্তিখন্ডনের জন্য আলাদা সময় বরাদ্দ থাকে না বিধায় নির্ধারিত সাত মিনিটের মাঝেই বক্তাদেরকে যুক্তিখন্ডন করতে হয়। পুরো বিতর্কটি একজন স্পিকার পরিচালনা করেন।
বারোয়ারি বিতর্ক:
বিতর্কের শিল্পিত ধারার নাম বারোয়ারী বিতর্ক। বারোয়ারি বিতর্ক মূলত বক্তাকেন্দ্রিক। এ বিতর্কে পক্ষ-বিপক্ষ থাকে না। প্রত্যেকে স্বাধীনভাবে একক ভাবনায় বিতর্ক করতে পারে। এ কারণেই এটি বিতার্কিকদের জন্যে একইসাথে কঠিন ও সৃজনশীল একটি জায়গা।
বারোয়ারি বিতর্কে বক্তা যেহেতু খুব বেশি স্বাধীন আর বিতর্কের বিষয়কে ভেঙেচুড়ে যেকোনো রূপ দেয়ার বিষয়ে তার পূর্ণ অধিকার রয়েছে, তাই ভাল-খারাপের দায়ভারও পুরোটাই তার উপরে বর্তায়। মোটকথা, এটি ব্যক্তিনির্ভর বিতর্ক, দলীয় নয়। চিন্তাজগতের নতুনত্ব ও সৃষ্টিশীলতা এই বিতর্কের প্রাণ। সাধারণত বারোয়ারি বিতর্কের বিষয়গুলো সংসদীয় বা সনাতনী বিতর্কের তুলনায় একটু ভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। বারোয়ারি বিতর্ক বলতে গেলে একধরনের একক অভিনয়। তবে এখানে বক্তার বক্তব্য হচ্ছে স্ক্রিপ্ট, অভিনয়ের ক্ষেত্র হলো মঞ্চ আর বিতর্কের ক্ষেত্র হলো সামনে থাকা ডায়াস।
আবার উপস্থাপনার দিক থেকে আবৃত্তির সাথে অনেক মিল থাকে এ বিতর্কের। অনেকটা শৈল্পিক ধাঁচের হলেও, আর সব বিতর্কের মতো বারোয়ারি বিতর্কেও যুক্তিনির্ভর কথা থাকতে হয়। এখানে কথাগুলো হবে সুচারু শব্দচয়নে গাঁথা ও মনমুগ্ধকর এবং এর উপস্থাপনা হবে চমকপ্রদ। এ উপস্থাপনায় বৈচিত্র্য আনতে কন্ঠের ওঠানামায়, আবেগের কমবেশিতে কখনো গ্রহণযোগ্যমাত্রায় নাটকীয়তা ও আবৃত্তির ঢং আসতে পারে। সবশেষে, আবৃত্তি, একক অভিনয়, উপস্থিত বক্তৃতা আর বিতর্ক এই চারে মিলে বারোয়ারি বিতর্ক হয় বলে আমরা উপসংহার টানতে পারি।
বারোয়ারি বিতর্কে যেহেতু কোনো দল নেই, সুতরাং এ প্রতিযোগীতায় যেকোনো সংখ্যক প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করতে পারে। সাধারণত বারোয়াতি বিতর্কে প্রত্যেক অংশগ্রহণকারীর জন্য তিন থেকে চার মিনিট সময় বরাদ্দ থাকে।
প্রদর্শনী বিতর্ক:
প্রদর্শনী বিতর্কগুলির মাঝে গঠনগত দিক থেকে সাধারণত বিশেষ কোনো নতুনত্ব থাকে না। ব্যাকরণিক জায়গা থেকে প্রদর্শনী বিতর্কগুলো মূলত সংসদীয় ফরম্যাটে হয়ে থাকলেও এসব বিতর্ক মূলত দর্শকদের বিনোদন দেয়ার উদ্দেশ্যে আয়োজন করা হয়ে থাকে। বিতর্কের মতো গুরুগম্ভীর বিষয়ে মাঝে মাঝে আনন্দেরও প্রয়োজন হয় বৈকি!
পৃথিবীর কোনো কিছুই স্থায়ী না, সব কিছুই আপেক্ষিক। বিতর্কও এর বাইরে নয়। তাই সময়ের প্রয়োজনে বিতর্কের ফরম্যাটেও প্রতিনিয়ত এসেছে নানাবিধ পরিবর্তন। তবে প্রচলিত বিতর্কের ফরম্যাটগুলোর মাঝে মোটামুটিভাবে এ কয়টি ফরম্যাটই বর্তমানে বেশি দেখা যাচ্ছে।
আমাদের সাথে যুক্ত থাকুন। আমরা নিয়মিত – বিতর্ক কি, বাংলা বিতর্ক, বিতর্ক পদ্ধতি, বিতর্ক সভার বৈশিষ্ট্য, সনাতনী বিতর্ক প্রতিযোগিতার নিয়ম, বিতর্ক ইংরেজি সহ বিভিধ বিষয় নিয়ে নিয়মিত আর্টিকেল প্রকাশ করবো।
আরও পড়ুন: