কেন করব বিতর্ক আজকের ভিডিওর আলোচনার বিষয় । বিতর্ক এর নিয়মাবলী সহ ডিবেটের সকল নিয়েমাবলি নিয়ে আমাদের একটি সিরিজ “বিতর্কের সহজ পাঠ [ Simple Lesson In Debate ]” সম্প্রতি প্রকাশিত হচ্ছে।
কেন করব বিতর্ক
‘তোমার মতের সঙ্গে আমি একমত না–ও হতে পারি, কিন্তু তোমার মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য আমি জীবন দিতে পারি।’ ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ারের এই উক্তির আনুষ্ঠানিক চর্চা করে বিতর্ক। তবে বিতর্ক নিয়ে আমাদের দেশের বহু মানুষের চিন্তা এখনো ইতিবাচক নয়।
তাঁরা মনে করেন বিতার্কিকেরা সবকিছুতেই তর্ক করার চেষ্টা করেন। বিতর্কবিরোধীরা বিশ্বাস করেন, ‘যুক্তি দিয়ে মুক্তি মেলে না’ কিংবা ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর’। কিন্তু এই কথা দুটোতেও গলদ রয়েছে। কখন বিশ্বাসে আস্থা রাখতে হবে আর কখন যুক্তিতে ভর করে এগোতে হবে সেটিও একজন বিতার্কিক তাঁর বিচক্ষণতা দিয়ে বুঝে নিতে পারেন। অন্ধবিশ্বাসের গলিতে আলো ফেলে সামনে এগোতে পারেন। প্রশ্ন করে সত্য উন্মোচন করার মতো সাহসী প্রজন্ম গড়ে তোলে বিতর্ক। যার শুরুটা করেছিলেন গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস।
ঝগড়াতে যুক্তি মুখ্য নয়। সেখানে থাকে জোর, বিতর্কে জোরের নয়, যুক্তির জয় হয়। বি-তর্ক মানে বিশেষ তর্ক। এই তর্ক সতর্কতার সঙ্গে করতে হয়। গোঁড়ামি, কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে কথা বলতে হয়, কথা বলতে হয় কাউকে আঘাত না করে, সম্মান বজায় রেখে বিনয় ও বিচক্ষণতার সঙ্গে।
বিরূপাক্ষ পাল তাঁর বিতর্ক ভুবন বইয়ে বিতর্ককে উল্লেখ করেছেন একটি ‘উদ্বুব্ধকরণ শিল্প বা আর্ট অব মোটিভেশন’ হিসেবে। তিনি মনে করেন, উদ্বুদ্ধকরণের শর্ত ছাড়া বক্তৃতা অনেকটা পাগলের কূটতর্কে পরিণত হয়। তাই বিতর্ক হচ্ছে- মন জাগানোর মন্ত্র, মন গলানোর কলা। মানুষকে শুভকাজে টেনে আনার সবচেয়ে বেশি ক্ষমতা ভালো কথার। আর তাই বিতর্ক হচ্ছে ভালোভাবে কথা বলার বিদ্যা।
বিতর্কশাস্ত্রের জনক বিবেচনা করা হয় ডেমস্থেনিসকে। তিনি যখন বক্তৃতা করতেন, তখন মানুষ এতটাই উদ্বুদ্ধ হতো যে তাঁরা বলত—‘চলো এখনই এগিয়ে যাই’। অর্থাৎ ডেমস্থেনিস যেদিকে আহ্বান করতেন, লোকে সেদিকে এগিয়ে যেত। নিজের চিন্তাকে প্রকাশ ও মানুষের কাছে সেটিকে গ্রহণযোগ্য মাত্রা দিতে বিতর্ক অত্যন্ত চমৎকার একটি মাধ্যম।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে নির্বাচনী বিতর্ক তারই নজির। আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গ বক্তৃতা, মার্টিন লুথার কিং-এর ‘আই হ্যাভ আ ড্রিম’ কিংবা বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের মধ্যে এক অসম্ভব সম্মোহনী শক্তি রয়েছে। বিশ্বের লক্ষকোটি জনতা আজও উদ্বুদ্ধ হয় এই বক্তৃতাগুলো শুনলে। একজন বিতার্কিক চর্চার মাধ্যমে এই জাদুকরি গুণটি রপ্ত করতে পারেন।
বিতর্কের সবচেয়ে বড় গুণ এটি নিজেকে প্রকাশ করতে শেখায়। একজন শিক্ষার্থীর জ্ঞান ও সুপ্ত প্রতিভাকে প্রকাশ করে বিতর্ক। এটি কোনো বিষয় ও সমস্যা সম্পর্কে শিক্ষার্থীকে ভাবতে ও বিশ্লেষণ করতে শেখায়। ধরা যাক, বল্যবিবাহ নিয়ে একজন শিক্ষার্থী তার পাঠ্যবইয়ে পড়েছে। ঠিক এ বিষয়েই যদি ওই শিক্ষার্থীকে বিতর্ক করতে দেওয়া হয় যে, ‘আইনের প্রয়োগই পারে বাল্যবিবাহ ঠেকাতে’। এই শিক্ষার্থী তখন তার পুঁথিগত বিদ্যা, সমাজবাস্তবতা ও নিজস্ব চিন্তার প্রয়োগ ঘটিয়ে বিষয়টির পক্ষে বা বিপক্ষে বক্তব্য তুলে ধরবে। এর মধ্য দিয়ে জীবনের যে স্তরেই বাল্যবিবাহ নিয়ে লিখতে বসুক না কেন, সে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে থাকবে।
বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের প্রথম ক্লাসে আমার শিক্ষক আকসাদুল আলম বলেছিলেন, যদি তুমি কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে পারো এবং সেই চিন্তাকে সুন্দরভাবে লিখতে ও বলতে পারো, তাহলে জীবনে যে ক্ষেত্রেই তুমি যাও না কেন, তুমি অন্যদের থেকে এগিয়ে থাকবে। একজন বিতার্কিককে তাঁর অবস্থানের পক্ষের যুক্তি ও তথ্য সংগ্রহ করার জন্য বই-পত্রিকা পড়তে হয়। সেগুলোকে নিজের ভাষায় লিখতে হয়, নিজের চিন্তা, বিশ্লেষণ সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে হয় এবং প্রতিপক্ষের যুক্তি খণ্ডন করার জন্য তাঁদের কথাগুলো মনোযোগসহকারে শুনতে হয়। ফলে ভালো বক্তা হওয়ার জন্য ভালো পাঠক ও শ্রোতা হওয়া জরুরি।
অন্যের মতকে সহ্য করার মানসিকতা এবং সময়ানুবর্তিতা শেখায় বিতর্ক। অনেক সময় দেখা যায়, বিভিন্ন সভা বা অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিতে গিয়ে বক্তা ১০ মিনিটের বক্তৃতায় ৫-৬ মিনিট নষ্ট করে ফেলেন অতিথিদের নাম ও বিশেষণ বলতে গিয়ে। আবার কেউ কেউ ভালো বক্তা না হয়েও অধিক সময় ধরে বক্তব্য দিয়ে শ্রোতাদের বিরক্তিভাব বৃদ্ধি করেন। বিতর্কচর্চার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সব কথা বলার কৌশল রপ্ত করতে পারেন।
বিতর্ক একজন অন্তর্মুখী শিক্ষার্থীকে বহির্মুখী করে তোলে। বিতর্ক করতে গিয়ে নানা স্থানে নানা মানুষের সঙ্গে পরিচয় ঘটে, আলাপ হয়। এর মধ্য দিয়ে সম্পর্ক ও পরিচিতি গড়ে ওঠে। এভাবে তৈরি হওয়া যোগাযোগদক্ষতা পরবর্তী জীবনের নানা ক্ষেত্রে কাজে লাগে। তাই বিতর্ক একটি শিল্প, একটি আন্দোলন।
বিতর্কের মধ্য দিয়ে একজন মানুষ শৈল্পিকভাবে তার মনের ভাব যেমন প্রকাশ করতে পারে, তেমনি সামাজিক নানা অসংগতির বিরুদ্ধে যৌক্তিকভাবে নিজের মতপ্রকাশের আন্দোলনে যুক্ত হতে পারে, নেতৃত্ব দিতে পারে। তাই বিতর্কের সর্বজনীন চর্চার মধ্য দিয়েই ভবিষ্যতের স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে এগিয়ে যেতে হবে।
কেন করব বিতর্ক নিয়ে বিস্তারিত ঃ
আরও দেখুনঃ