আজকের আলোচনার বিষয়ঃ বিতার্কিকের কবিতা
একজন বিতার্কিকের মূল লক্ষ্য নেতৃত্বের ক্ষমতা অর্জন। এ নেতৃত্ব রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক বা সামাজিক হতে পারে। ন্যূনতম যুক্তিবোধ হচ্ছে বিতর্কের প্রয়োজনীয় শর্ত, যার ভিত্তি যুক্তিশাস্ত্র, নীতিশাস্ত্র ও মনস্তত্ত্ব, যা শাস্ত্রগতভাবে পাঠ না করলেও স্বাভাবিকভাবে কমবেশি প্রতিটি মানুষের মধ্যে গড়ে ওঠে। প্রয়োজনীয় শর্তের ভিত্তি হিসেবে এই তিনটি বিষয় দেখিয়ে এটা বোঝানো হয়নি যে, আগে তিনটি বিষয়ে স্নাতক সম্মান ডিগ্রি নিতে হবে। এগুলো স্বাভাবিকভাবেই গড়ে ওঠে। তবে এগুলো পাঠ করলে তা বিতার্কিকের জন্য অবশ্যই উপকারী হবে।

বিতার্কিকের কবিতা
যে আমি বিতর্ক করি
সে আমিই জ্বলে উঠি দ্বিমুখী শক্তির দ্বন্দ্বে
নতুন সৃষ্টির অঙ্গীকারে।
জ্বলে উঠি সর্বক্ষণ নজরুলের বজ্র বিদ্রোহের বিস্ফোরণে।
জ্বলে উঠি নান্দনিক রবীন্দ্রনাথের সেই আনন্দযজ্ঞের আহুতিতে ।
জ্বলে উঠি নিরন্তর জীবনানন্দের সেই অদ্ভুত আঁধার পৃথিবীতে।
জ্বলে উঠি যেমনটি এঙ্গেলস অথবা মার্ক্স বস্তুবাদে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হেগেলের সাথে ।
জ্বলে উঠি বিশ্বযাত্রী কলম্বাসের সেই তরঙ্গযাত্রার প্রতীক্ষায়।
জ্বলে উঠি দার্শনিক জ্যাঁ পল সার্ত্রের সেই অস্তিত্ববাদের চেতনায় ।
তবুও বিতর্ক করি
জ্বলে উঠি বারবার দ্বিমুখী শক্তির দ্বন্দ্বে
জ্বলে উঠি বারবার যুক্তিবলে উদ্বুদ্ধকরণে।
নতুন সৃষ্টির অঙ্গীকারে।
জ্বলে উঠি বারবার অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে ।

সে জন্যে বিতর্ক করি
যে জন্যে মানুষ হয়ে করে যাই শ্রেষ্ঠত্বের দাবি,
চেতনায় উজ্জীবিত বিচারবুদ্ধির শক্তি
শাণিত করার প্রয়োজনে।
সে জন্যে বিতর্ক করি
যে জন্যে সাহসী যাত্রী সৃষ্টি করে ভিন্নতর পথ।
মতের স্বাতন্ত্র্য সে তো মানবসত্তারই প্রতিভাস ।
দৃষ্টির প্রদীপ প্রজ্বলনে ।
সক্রেটিস প্লেটো যদি না দিত দর্শন,
বিতর্ক নিশ্চিত হতো নির্বাসিত দূরে।
ফরাসি বিপ্লব যদি না দিত চেতনা,
রুশো ভল্টেয়ার যদি না ছড়াত বাণী,
বিশাল নেতৃত্বে মাও সে তুং
আজও যেন হতবাক করে আমাদের।
রুশ বিপ্লবের সেই দুনিয়াকাঁপানো দশ দিন ।
মহামতি লেনিনের মুক্তির মন্ত্রণা।
আব্রাহাম লিংকনের গণতন্ত্র বাণী ।
গান্ধীর অহিংসবাদ, বর্ণবাদ প্রতিরোধে
মার্টিন লুথার কিং ডাক দিয়ে যায়।
অগ্নিঝরা বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাগায়।
সবকিছু হতবাক করে আমাদের,
বিস্মিত নন্দিত উচ্চারণে।
উদ্বুদ্ধ করার শিল্প বিতর্ক তাড়িত করে
চেতনার সত্তা অন্বেষণে।
তাই তো বিতর্ক করি
জ্বলে উঠি বারবার দ্বিমুখী শক্তির দ্বন্দ্বে
নতুন সৃষ্টির অঙ্গীকারে।
জ্বলে উঠি আফ্রিকার হাড্ডিসার শিশুর চিৎকারে।
যুক্তরাষ্ট্রে বেড়ে যায় সমরসজ্জার আয়োজন।
প্রাচুর্যের ইউরোপে ঘন ঘন মন্দার আঘাত ।
এশিয়া ধরেছে আজ পৃথিবীর প্রবৃদ্ধির হাল ।
তথাপি বেড়েই চলে ধনী-গরিবের ব্যবধান।
একদিকে বিশ্বায়ন অনিবার্য গতি ।
কেন তবে থেমে যায় জাতির সম্প্রীতি?

অসংগতি বেড়ে যায় সংগতির চেয়ে,
একজন বিতার্কিক জেগে ওঠে এই বক্ষ মাঝে
গভীর প্রত্যয়ে ।
তাই তো বিতর্ক করি।
সাম্প্রদায়িকতা কিংবা মৌলবাদ প্রতিরোধে
মানবিক আদর্শের সঙিন উঁচিয়ে।
স্বাধীনতা একাত্তর বাঙালিকে গিয়েছে শিখিয়ে।
একদিন সন্ধ্যাবেলা বন্ধুবর বললেন,
“বিতর্ক কোরো না বন্ধু, নড়ে যাবে বিশ্বাসের ভিত।
সত্য মিথ্যা ভবিষ্যতে হয়ে যাবে ওলট-পালট।’
তার চিন্তা ভ্রান্ত আজ, আমি নই সন্দিহান প্রাণী।
না করে কিঞ্চিৎ প্রশ্ন সবকিছু মেনে নেওয়া
মানবসত্তার বিপ্রতীপ—এ বিশ্বাস করি।
তাই তো বিতর্ক করিজেগে উঠি
চেতনার বহ্নি বাতায়নে ।
বিশ্বাসের ভিত গড়ে তুলি
অসংখ্য যুক্তির সম্মিলনে ।
যে আমি বিতর্ক করি
আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে
সে ‘আমি’র সবকিছু বড়ই কঠিন কাষ্ঠপ্রাণ ।
ঠিক নয় সে ধারণা।
দ্বন্দ্বের কল্যাণে ঘটে অন্তরের শুদ্ধি অভিযান।
একজন বিতার্কিক সজাগ মানুষ।
তারও আছে প্রাণ মন অনুরাগ কিংবা অভিমান ।
তারও আছে বিরহ বেদনা কিংবা কষ্ট অপেক্ষার।
তারও আছে কত শক্তি
ভালোবাসা বিলিয়ে দেবার।
যে আমি বিতর্ক করি
সে আমিই জ্বলে উঠি দ্বিমুখী শক্তির দ্বন্দ্বে
নতুন সৃষ্টির অঙ্গীকারে।
যুক্তিযুদ্ধে সব্যসাচী, চেতনায় অনির্বাণ
অন্তরের সীমান্ত বিস্তারে ।
