আজকে আমরা আলোচনা করবো বিতর্ক ও যুক্তিবাদী সমাজের বিনির্মাণ

বিতর্ক ও যুক্তিবাদী সমাজের বিনির্মাণ
দু হাজার দশকের মাঝামাঝি যখন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে আবার ছাত্রত্ববরণ করেছি। তখনকার মনোভাব নিয়ে রচিত আমার এ লেখাটি সদাই প্রাসঙ্গিক, অন্তত বিতর্ক অঙ্গনে। তাই সে কথা আবার তুলে ধরলাম ।
“মহান ব্যক্তিরা তাঁদের লেখার মধ্যে বেঁচে রয়েছেন – যেমন ফ্রান্সিস বেকন বলেছেন । তবে মহাত্মা গান্ধী আমাদের অন্য কথা বলেন। তিনি নিজের সব লেখা তাঁর শেষকৃত্যের সময় পুড়িয়ে ফেলতে বলে দিয়েছিলেন। তাঁর যুক্তি, তাঁর কাজগুলোকেই এই পৃথিবী মনে রাখবে, তাঁর কথা বা লেখাগুলোকে নয় ।
আমি মনে করি, গান্ধীর এই দর্শন নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। এ ক্ষেত্রে বড় বড় কথা ও হালকা উপদেশ নিরর্থক। বরং বিতর্কের এই যুদ্ধক্ষেত্রে বাস্তব প্রচেষ্টার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। এই প্রচেষ্টা সেরা বিতার্কিক হওয়ার জন্য যেমন জরুরি, তেমনি বিচক্ষণ মানুষ হওয়ার জন্যও অপরিহার্য।
তাই কেউ যখন আমাকে কিছু লিখতে বলেছে, আমি অপরাধবোধে আক্রান্ত হয়েছি। যখন আমি পড়াশোনার জন্য বিদেশে ছিলাম তখন সরাসরি হাজির না থাকায় বিতর্কের জন্য কিছুই করতে পারছিলাম না। গান্ধী আবার আমায় মনে করিয়ে দেন, ‘উপদেশ বিলানোর পরিবর্তে বাস্তবে কিছু করে দেখানোর চেষ্টা করো।’ সুতরাং এই নিবন্ধের মূল ভাবনায় একগুচ্ছ উপদেশ দেওয়ার উদ্দেশ্য নেই। বরং বিতর্ক নিয়ে কিছু অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টিভঙ্গি বিনিময়ের আগ্রহ পোষণ করছি।
বিতর্ক আমাকে বিপুল সৃজনশীলতার আনন্দ দিয়েছে ৷ একটা বিতর্ক সংগঠনের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে আমি সামাজিকীকরণ, অঙ্গীকার এবং দলভিত্তিক কার্যক্রমের চেতনা বা টিমওয়ার্ক স্পিরিট প্রভৃতি বিষয়ে অনেক কিছু শিখতে পেরেছি। অনেক হাততালির কথা আমি ভুলে গিয়েছি, কিন্তু কান্নাগুলো ভুলিনি। আসলে কান্নাগুলোই আমার জীবনের বড় পুরস্কার, এসবের মূল্য হাততালির চেয়েও বেশি।

তবু অনেকের মনে প্রশ্ন : কেন আমি দেশ ছেড়ে গেলাম। বিতর্কের যুদ্ধক্ষেত্রটা কেন ত্যাগ করলাম যখন সেটা একটা ভারসাম্য এবং সাফল্যের পথে এগোচ্ছিল? সেই ভ্রাম্যমাণ পাখির গল্পটা আপাতত থাক। কিন্তু একটা বিষয় আমি স্পষ্ট করে দিতে চাই যে বিতার্কিকদের বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ ছিল না। বিতর্ক নিয়ে যত স্মৃতি আমাদের আছে তাতে ছায়ার তুলনায় আলোকচ্ছটাই বেশি। তবে আমার একধরনের অপরাধবোধ আছে—ওরা আমাকে খুব পছন্দ করত কিন্তু আমি তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী প্রতিদান দিতে পারিনি। তাই বাংলাদেশের বিতার্কিকদের জন্য আমার কিছু করার একটা স্বপ্ন আছে। ভবিষ্যতে সুযোগ এলে আমি অবশ্যই সেটা করব।
বিতর্ক এখন আর শ্রেণিকক্ষের বিনোদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। অথবা এটা টেলিভিশনের প্রতিযোগিতার জন্যও সৃষ্টি হয়নি। বিতর্কের অবশ্যই কিছু লক্ষ্য এবং দর্শন থাকা চাই। তাই বিতর্কের বিষয় বা টপিক বাছাইয়ের কাজটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় পর্যায়ের সব বিষয়ে বিতর্কের ব্যাপক প্রয়োগ হলে সেটা আমাদের সমাজের জন্য অনেক সুফল বয়ে আনবে। বিতর্ক মানে কেবল কথা বলা নয়। যদি তাই হতো, রাজনৈতিক বক্তৃতাবাজিই (শব্দদূষণ সহযোগে) বিতর্কের জায়গা নিয়ে নিত। বিতর্ক হচ্ছে যুক্তি ও ধৈর্যসহকারে কথা বলার একটা শিল্প। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, রাজনীতিতে আমরা যুক্তির দেখা কমই পাই। আমাদের সমাজে সহনশীলতার অভাবও উল্লেখযোগ্য।
আমি যখন বাংলাদেশে ছিলাম, মনে করতাম দেশটাকে বিদেশের লোকজন শুধু দারিদ্র্যের জন্যই চেনে। কিন্তু দেশের সীমানা পেরোনোর পরই আমার ভুলটা ভাঙল । আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি কেবলই দারিদ্র্যসর্বস্ব নয়। ওরা কোনো দেশকে দরিদ্র দেখলে কিছু মনে করে না, যদি সেই দেশ নিজেদের উন্নয়নের চেষ্টায় ব্যস্ত থাকে। বরং সমৃদ্ধ দেশগুলো যেকোনো উন্নয়নশীল দেশের কঠোর পরিশ্রমী জীবনযাত্রার প্রতি বেশ আগ্রহ ও সম্মান দেখিয়ে থাকে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর দ্রুত প্রবৃদ্ধির কারণ নিয়ে গবেষণা করে উন্নত বিশ্বের মানুষ ।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশ বহির্বিশ্বে মূলত দুর্নীতি ও গোঁড়ামির জন্য আলোচিত। এগুলো অনেকটা দুরারোগ্য অসুখের মতো দারিদ্র্য কোনো রোগ নয়, এটা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির একটা পর্যায়। তবে দুর্নীতি ও গোঁড়ামির জীবাণু আমাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করেছে। এ জন্য কোন কোন গোষ্ঠী দায়ী, সেটা একজন স্বপ্নদর্শী বিতার্কিককে খুঁজে বের করতে হবে। তিনি বুঝতে পারবেন, এ ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত। দূরদৃষ্টিহীন রাজনীতিবিদেরা জনগণের আবেগ-অনুভূতির সুযোগ নেন এবং স্বার্থের জন্য ধর্মকে ব্যবহার করেন । কিন্তু এই নোংরা চর্চায় দীর্ঘ মেয়াদে জাতীয় উন্নয়ন ব্যাহত হয় ।
আগামী দিনের বিতর্ক তার নিজস্ব শক্তি ও লক্ষ্য নিয়ে দুর্নীতি ও গোঁড়ামির বিরুদ্ধে লড়াই করবে। বিতর্কই একমাত্র সমাধান নয়, তবে এটা অনুপ্রেরণার একটা উপাদান । একটা গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি হিসেবে বিতর্ক যেকোনো কর্তৃত্ববাদী নির্দেশ বা বলপ্রয়োগের চেয়ে শতগুণ বেশি কার্যকর। এটা মানুষকে বিশ্লেষণী ক্ষমতা দেয়, যা যেকোনো সামাজিক দুরবস্থার মূল কারণ খুঁজে বের করতে সহায়ক। যেমন দুর্নীতি দমনের জন্য আমাদের কী করতে হবে? উত্তরটা একটা শব্দের মধ্যেই আছে ‘ন্যায়বিচার’। কিন্তু একজন বিতার্কিক এত সাধারণভাবে সেটা বলবেন না । গভীর বিশ্লেষণের মাধ্যমে আরও দৃষ্টান্ত কিংবা তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে যুক্তির সঙ্গে কথা বলবেন।
বাংলাদেশে ন্যায়বিচার বিলম্বিত হয়- এটা স্পষ্ট। বিলম্বিত বিচার মানে অবিচার। এমনকি বাংলাদেশে ‘বাছবিচারপূর্ণ বিচার’ (সিলেকটিভ জাস্টিস) হয়ে থাকে। বিচারপ্রক্রিয়া দীর্ঘসূত্রতার জন্য কিছু বিচার চিরকালের জন্য ঝুলে থাকে। ‘পক্ষপাতমূলক বিচার অবিচারের চেয়ে খারাপ; আর বিকৃত বিচার অবিচারের চেয়ে বেশি বিপজ্জনক দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের অনেক ক্ষমতাপাগল ব্যারিস্টার নিজেদের আদর্শ দায়িত্ব পালনের চেয়ে রাজনীতিতে বেশি উৎসাহী থাকেন । আমাদের অনেকে ইতিমধ্যে ভুলে গেছি, আমাদের পেশাগত সীমারেখা কতটুকু হওয়া উচিত।
আমরা কি সেক্যুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিয়ে কোনো আধুনিক দেশের কথা কখনো চিন্তা করতে পারি? আমাদের এটা ছিল। সামরিক শাসকেরা সেটি মুছে দিয়েছিলেন। আমরা তখন পেছনের দিকে হেঁটেছি। আমরা একটা আধুনিক দেশ হতে চাই। আজও আমাদের বৈশ্বিক ভাবমূর্তি গোঁড়ামি বা আদিম মানসিকতার কারণে মাঝে মাঝেই আক্রান্ত হয়ে যায়। একজন বিতার্কিক বলতে পারবেন উভয় সংকটের শেকড়টা কোথায়? আমরা একটা বিষাক্ত আইভিলতা থেকে গোলাপ ফুল পাওয়ার আশা করতে পারি না। তাহলে উপায় কী?
বাংলাদেশে বিতর্কের ভবিষ্যৎ কঠিন হয়ে পড়বে যদি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হুমকির মুখে পড়ে। বাংলাদেশের বিতার্কিকদের এখন শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তোলা উচিত, যাতে তাঁরা পক্ষপাতমূলক বিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে পারেন এবং বৈষম্য নিরসনে কাজ করতে পারেন। ধর্ম ব্যক্তিগত; মানবতা সর্বজনীন -এ বিশ্বাস পালন করতে পারেন।
আমরা বিতার্কিক! আমরা সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র তুলে ধরি প্রেরণা ও বুদ্ধিমত্তা, পাশাপাশি জ্ঞান ও সততার সমর্থন, সঙ্গে ধৈর্য ও ভালোবাসা। কোনো শক্তিই আমাদের হারাতে পারে না। একটা যুক্তিবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠা করাই আমাদের স্বপ্ন। এটাই আগামী দিনের বিতার্কিকদের মূল সংগীত। এই চেতনাধারক তর্কসেনারা স্বপ্নের আদলে বিতর্ককে নতুন রূপ দিতে অঙ্গীকারবদ্ধ।
