আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়ঃ বিতর্কের বজ্র মডেল

বিতর্কের বজ্র মডেল
বিশ্বাস ও তাৎক্ষণিকতার চর্চা
সব সময় বিশ্বাস আঁকড়ে ধরে বিতর্ক করা যায় না। প্রতিপক্ষের বিশ্বাসগুলোর মূলভিত্তি বা যুক্তিগুলো কী সেটা জানাও জরুরি। এই প্রয়োজনীয়তার কথা ‘বিতর্কে বিশ্বাস’ শিরোনামে আরেকটি লেখায় উদাহরণসহ নিবেদিত হবে। বর্তমান লেখায় বিতর্ক মডেলের এক নতুন নিরীক্ষা পরিবেশিত হলো। বিতার্কিকেরা সৃজনশীলতার মন্ত্রে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে এগিয়ে যান। তারই প্রতিফলন বিতর্কের বজ্র মডেল (Thunder Model)।
এ নামকরণের পেছনে একটা প্রকৃতির চিত্র কল্পনা করা হয়েছে। বিদ্যুৎ চমকানোর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বজ্রপাত ঘটে। এখানে বিষয়বস্তু প্রদানও বজ্রপাতের মতো আকস্মিক। যিনি বজ্রপাত ঘটালেন, তিনি বিশ্বাসের পক্ষেই ঘটালেন। বিপক্ষ তাৎক্ষণিকতার প্রমাণ দিলেন। এ জন্যই বস্ত্র বিতর্ক বিশ্বাস ও তাৎক্ষণিকতার চর্চা। ‘বজ্র মডেল’-এর প্রাথমিক রূপরেখা এখানে প্রদান করা হলো।
বহু মডেলের বিন্যাস
‘বিশ্বাসের পক্ষে বিতর্ক এবং তাৎক্ষণিক দক্ষতা অর্জনের বিতর্ক-এ দুই ধারণাকে সম্পৃক্ত করে এই মডেল উপস্থাপিত। এর সংক্ষিপ্ত নিয়মাবলি নিম্নরূপ
১. এর মঞ্চবিন্যাস পূর্ববৎ। তবে বক্তাদের বিভিন্ন অবস্থান ও গুরুত্ব বিবেচনায় বিভিন্ন নামে আখ্যায়িত করা যায়। সভাপতির বদলে থাকবেন ‘উপদেষ্টা’, যিনি বিতর্ক পরিচালনা করবেন। বিন্যাস নিম্নরূপ

২. প্রত্যেকে তিন মিনিট করে বলবেন। কেবল উত্থাপক চার মিনিট বলবেন।
৩. প্রথমে উপদেষ্টা উত্থাপককে তাৎক্ষণিক বিষয়বস্তু উত্থাপনের আমন্ত্রণ জানাবেন।
৪. উত্থাপক একটি বিষয়বস্তু উত্থাপন করবেন, যা তাঁর বিশ্বাসের পক্ষে বলার সুযোগ দেবে। ধরা যাক, তিনি বিষয় উত্থাপন করলেন, ‘ভবিষ্যৎ বিশ্বে মর্যাদা অর্জনে এ দেশের ক্রীড়ার চেয়ে সংস্কৃতির সম্ভাবনা উজ্জ্বল।’ এটা তিনি বিশ্বাস করেন এবং তাঁর পক্ষে বলার প্রস্তুতি তিনি নিয়ে এসেছেন দলবলসহ।
৫. এবার উপদেষ্টা তাৎক্ষণিকভাবে বিচার করবেন এটা বিতর্কযোগ্য কি না, কিংবা এটা যথেষ্ট ভারসাম্যপূর্ণ বিষয় কি না। যদি উত্থাপক ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে মানব অস্তিত্ব বিপন্ন হবে’ কিংবা ‘করদাতারা সৎ হলেই আমাদের দারিদ্র্য নিরসন সম্ভব নয় – এ ধরনের বিষয় উত্থাপন করেন, তাহলে বিপক্ষ অবশ্যই কোণঠাসা হয়ে যাবেন। কারণ, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে মানব-অস্তিত্ব বিপন্ন হবে না—এটা কেউই বলতে চাইবেন না। কিংবা, করদাতারা সৎ হলেই আমাদের দারিদ্র্য নিরসন হয়ে যাবে, এটা একটা অবিশ্বাস্য কথা।
এ ক্ষেত্রে উপদেষ্টা বিষয়টিকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ ঘোষণা করে দ্বিতীয় বিষয়বস্তু উত্থাপনের সুযোগ দেবেন। পর পর তিনটি উত্থাপিত বিষয় অগ্রহণযোগ্য হলে সে দলকে আর সুযোগ দেওয়া যাবে না। উপদেষ্টা প্রথম পর্যায়ের বিতর্কের ইতি ঘোষণা করে দ্বিতীয় পর্যায়ের সূত্রপাত করবেন। উপদেষ্টা মঞ্চবিন্যাসের দেওয়া নাম ঘোষণায় ব্যবহার করবেন।
৬. যদি তৃতীয়বারের মতো উত্থাপিত বিষয়টি গ্রহণযোগ্য হয়, তাহলে উপদেষ্টা বিতর্ক শুরু করার অনুমতি দেবেন। উত্থাপক তাঁর বক্তব্য দেখবেন। তাঁকে তাৎক্ষণিকভাবে জবাব দেবেন বিপক্ষের পারঙ্গম।
তাৎক্ষণিক প্রস্তুতিতে জবাব দেবেন বলেই তিনি পারঙ্গম। সমস্ত বিতর্কে তিনি প্রথম আক্রমণ মোকাবিলা করেন প্রাচীন যুদ্ধের সেনাপতির মতো। তারপর পক্ষ দলের সংস্থাপক। তিনি উত্থাপিত বিষয়কে দৃঢ়ভাবে সংস্থাপিত করেন বলে তিনি সংস্থাপক।

সংস্থাপকের ভূমিকা ইতিহাসের বিভিন্ন রাজবংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতাদের মতো। অনেক ইতিহাসবেত্তা মনে করেন, বাবর নয়, আকবরই মোগল সাম্রাজ্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা। সংস্থাপকের পরে বলবেন অগ্রদূত। পারঙ্গমের পর অগ্রদূত দলকে আরেকটু এগিয়ে নেবেন। তারপর আসবেন বিস্তারক যিনি বিতর্ক করবেন আবার খণ্ডনও করবেন। আক্রমণ ও প্রতিরোধ দুটো কাজই করবেন সব্যসাচীর মতো সমান দক্ষতায়। এভাবে তিনি দলের সাম্রাজ্য বিস্তার করবেন। সবশেষে আসবেন বিপক্ষের সুরক্ষক, যিনি সমস্ত বিতর্কের শেষ প্রদীপ প্রজ্বলন করবেন যুক্তিরস, প্রজ্ঞা, খণ্ডন—সবকিছু দিয়ে।
৭. সাধারণত পক্ষের দল তাদের শ্রেষ্ঠ বক্তাকে সংস্থাপক বা বিস্তারকের আসনে বসাবে, যেখানে বিপক্ষ দল তাদের শ্রেষ্ঠ বক্তাকে অগ্রদূত বা পারঙ্গমের আসনে বসাবে। তবে এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন অবস্থা ও কৌশল বিবেচনা করে তাদের দল সাজাতে পারবে।
৮. কমপক্ষে ১৯ মিনিটে (৪+৩+৩+৩+৩+৩) প্রথম পর্যায় শেষ হবে । এবার দ্বিতীয় পর্যায়ে দলগুলো তাদের পক্ষ-বিপক্ষের অবস্থান পরিবর্তন করবে। এ পরিবর্তন তাদের নামফলক পরিবর্তন করেও করা সম্ভব। প্রথম পর্যায়ের পারঙ্গম দ্বিতীয়বার হবেন উত্থাপক। এ ক্ষেত্রে দল হয়তো অগ্রদূত সুরক্ষককেও উত্থাপক বানাতে পারে। সেটা তাদের ব্যাপার। দ্বিতীয় পর্যায় শেষ হলে তিন মিনিটের একটা মুক্তবাণী থাকবে। এখানে উপদেষ্টা তাঁর মুক্ত মতামত রাখতে পারেন। দ্বিতীয় পর্যায়, মুক্তিবাণীসহ বিতর্কটি শেষ
হতে ৪৫ মিনিটের বেশি সময় লাগবে না।
৯. প্রত্যেক বক্তা প্রতিটি বিষয়ে অন্যান্য বক্তৃতার মতোই নম্বর পাবেন । উত্থাপক যুক্তিখণ্ডনে অন্য নম্বরের সঙ্গে সংগতি রেখে নম্বর পাবেন।
১০. উভয় দল ইচ্ছা করলে বিপক্ষ দলের সুবিধার জন্য বিতর্ক বিষয় নয় বরং বিষয়ের বৃহৎ ক্ষেত্র আগে থেকে জানিয়ে দিতে পারে।
১১. উপদেষ্টার সঙ্গে বিচারকমণ্ডলী থাকবেন। উপদেষ্টা নিজেও বিচারক থাকতে পারবেন।
১২. বিষয়বস্তুর জন্য আলাদা নম্বর থাকবে, যা ৩ দ্বারা বিভাজ্য। এটা কোনো বক্তা নয়— দল পাবে। ধরা যাক নম্বরটি ১৮। এ ক্ষেত্রে উত্থাপকের উত্থাপিত একেবারে প্রথম বিষয়টিই যদি উপদেষ্টা গ্রহণ করেন, তাহলে ১৮ নম্বরের মধ্যে নম্বর প্রদান বিবেচনা করা হবে। যদি প্রথম উত্থাপিত বিষয়টি গৃহীত না হয় এবং দ্বিতীয় উত্থাপিত বিষয়টি গৃহীত হয়, তাহলে (১৮+১৮)+৩ = ১২ নম্বরের মধ্যে নম্বর প্রদান বিবেচনা করা হবে। যদি তৃতীয়টি গৃহীত হয়, তাহলে (১৮+১৮) + (৩×২)=৬ এর মধ্যে নম্বর দেওয়া হবে। যদি তৃতীয়টি গৃহীত না হয়, তাহলে বিষয়বস্তুটি (১৮- ১৮÷৩×৩)=০, অর্থাৎ কোনো নম্বর দেওয়া হবে না। এটাও একটা দক্ষতা। এ ক্ষেত্রে উত্থাপক দল সচেতন থাকবে তাদের উত্থাপনযোগ্য বিষয়বস্তুর গ্রহণযোগ্যতা, মান, ভারসাম্য প্রভৃতি নিয়ে।
সমাপনী
আমাদের রয়েছে বিষয়বস্তুর অভাব। আশা করা যায়, এ মডেলের চর্চায় বিষয়বস্তু রচনা করার দায়িত্ব বক্তাদের ওপর বর্তাবে, ঘুচবে এর দীনতা। নবীন বিতার্কিক এ মডেলের পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংযোজন, বিয়োজন সম্পর্কে মূল্যবান মতামত দেবেন—এটা সংগত চাওয়া। তবে সবকিছুই শ্রীবৃদ্ধি ও সৃজনশীলতার স্বার্থে উৎসারিত হোক। প্রসারিত হোক প্রজ্ঞা, যুক্তি; নন্দিত হোক বিতর্ক। বহু বিতর্ক অংশগ্রহণকারীদের তাৎক্ষণিক ক্ষমতা শক্তিধর করবে। বিশ্বাসের পক্ষে কথা বলতে গিয়ে উত্থাপক দল এও দেখবে যে, কীভাবে পারঙ্গমের দল তা মোকাবিলা করে। এ বিতর্কপদ্ধতির সতর্কতা হচ্ছে এখানে বিচক্ষণ উপদেষ্টা যথেষ্ট বিচক্ষণ হবেন যেন নির্বাচিত বিষয়দুটো ভারসাম্যপূর্ণ অর্থাৎ উভয় পক্ষের বলার মতো উপযোগী হয়।
