সংসদীয় বিতর্কের কিছু বিশেষ শব্দের ব্যাখ্যা

আজকের আলোচনার বিষয়—সংসদীয় বিতর্কে ব্যবহৃত কিছু গুরুত্বপূর্ণ শব্দের অর্থ, প্রেক্ষাপট ও প্রয়োগ। সংসদীয় বিতর্কে যুক্তি, পাল্টা যুক্তি, সংজ্ঞা ও স্ট্র্যাটেজির মতো উপাদানগুলো সুসংগতভাবে উপস্থাপন করার জন্য কিছু বিশেষ শব্দ বা টেকনিক্যাল টার্ম ব্যবহৃত হয়। এই শব্দগুলো সঠিকভাবে বুঝে ব্যবহার করতে পারলে বিতার্কিকরা স্পষ্ট, শক্তিশালী ও ন্যায়সঙ্গত বিতর্ক উপস্থাপন করতে পারেন।

 

সংসদীয় বিতর্কের কিছু বিশেষ শব্দের ব্যাখ্যা

 

সংসদীয় বিতর্কের কিছু বিশেষ শব্দের ব্যাখ্যা

Truism (ট্রুইজম)

সংজ্ঞা

Truism বলতে এমন একটি সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যা বোঝায় যা ধ্রুব সত্য, সর্বজনস্বীকৃত এবং বিতর্কের বিষয়বস্তুকে বিতর্কের অযোগ্য করে তোলে

অর্থাৎ, সরকারী দল যদি এমন একটি সংজ্ঞা নির্বাচন করে যা–

  • সকলের কাছে একেবারে সত্য,

  • বিতর্কের কোনও সুযোগ নেই,

  • যার বিপক্ষে যুক্তি বা ব্যাখ্যা দেওয়ার উপায় নেই,

তাহলে তাদের স্ট্র্যাটেজিকে Truism দোষ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

উদাহরণ

“The sun rises in the east.”
এটি একটি অবিসংবাদিত সত্য। এর পক্ষে বা বিপক্ষে কোনও বিতর্ক নেই।
যদি সরকারী দল একটি বিতর্কযোগ্য বিষয়কে এভাবে ধ্রুব সত্যের মতো সংজ্ঞা করে ফেলে, তবে বিরোধী দল নিজের ভূমিকা পালন করার সুযোগ হারায়।

কেন এটি দোষ?

Truism বিতর্কের মৌলিক ন্যায়পরায়ণতা নষ্ট করে দেয়, কারণ—

  • এখানে বিরোধী দল তাদের যুক্তি উপস্থাপন করতে পারে না,

  • কোনও প্রমাণ, পাল্টা যুক্তি বা বিশ্লেষণ দেওয়ার সুযোগ থাকে না,

  • পুরো বিতর্ক একপেশে হয়ে যায়।

সংসদীয় বিতর্কে দুই পক্ষের সমান সুযোগ থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, আর Truism সেই সুযোগ কেড়ে নেয়।

 

সংসদীয় বিতর্কের কিছু বিশেষ শব্দের ব্যাখ্যা

 

 

Tautology (টটোলজি)

সংজ্ঞা

Tautology হল এমন একটি পরিস্থিতি যেখানে সরকারী দল বিষয়টিকে এমনভাবে সংজ্ঞায়িত করে বা ব্যাখ্যা করে যে বিতর্ক একপক্ষীয় হয়ে যায়, এবং বিরোধী দলের হাতে কার্যত কোনও যুক্তি থাকে না।

এটি Truism থেকে কিছুটা আলাদা:

  • Truism একটি সর্বজনস্বীকৃত সত্য
  • Tautology একটি বিতর্কযোগ্য বিষয়কে এমনভাবে ঘুরিয়ে বলা, যাতে তা একপক্ষীয় ও অনিবার্য সত্যের মতো মনে হয়

উদাহরণ

ধরা যাক প্রস্তাবনা:
“This House supports freedom.”

যদি সরকারী দল সঙ্গায়ন করে বলে—
“Freedom means only the right to live safely.”
তাহলে বিরোধী দলের বলার কিছুই থাকে না। কারণ কে-ই বা নিরাপদে বেঁচে থাকার অধিকারকে অস্বীকার করবে?

অথচ বিষয়টি হতে পারত মানবাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ব্যক্তিস্বাধীনতা ইত্যাদি—যেখানে বিতর্কের সুযোগ বিস্তৃত।

কেন এটি সমস্যা?

Tautology বিতর্কের বিষয়কে–

  • সংকুচিত করে
  • একমাত্রিক করে
  • বিকল্প ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণের পথ রুদ্ধ করে

ফলে ন্যায্য বিতর্ক আর সম্ভব হয় না।

বিকল্প প্রস্তাব (Parallel Motion / Counter-model)

সংজ্ঞা

যদি সরকারী দল তাদের সংজ্ঞাকে Truism বা Tautology দোষে দুষ্ট করে ফেলে, তবে বিরোধী দল বিকল্প প্রস্তাব (Parallel Motion) দিতে পারে। এটি হলো— সরকারী দলের সংজ্ঞা সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করে, বিরোধী দলের নতুন একটি সঙ্গায়ন বা কাঠামো উপস্থাপন করা।

কখন Parallel Motion দেওয়া হয়?

  • সরকারী দলের প্রস্তাবনায় যুক্তিহীন চরম সংকীর্ণতা থাকলে

  • সংজ্ঞা এমনভাবে স্থাপন করা হলে যে বিরোধী দলের কিছু করার থাকে না

  • বিতর্কযোগ্য একটি বিষয়কে অ-বিতর্কযোগ্য করে তুললে

বিকল্প প্রস্তাব দেওয়ার নিয়ম

Parallel Motion দিলে বিরোধী দলের কাজ হলো—

  • তিনজন বক্তাই বারবার প্রমাণ করবে যে সরকারের সংজ্ঞা Truism/Tautology

  • সরকারের কোনও যুক্তির খণ্ডন করা যাবে না

  • বরং দেখাতে হবে, সরকারের সঙ্গায়নই বিতর্ককে অসম্ভব করেছে

  • এর পর তারা নিজেদের সংজ্ঞা স্থাপন করবে এবং সেই অনুযায়ী বিতর্ক চালাবে

উদাহরণ

প্রস্তাবনা:
“This House would improve education.”

সরকারি দল সংজ্ঞা দিল:
“Improving education means giving free notebooks to all students.”

এটি অত্যন্ত সংকীর্ণ ব্যাখ্যা। এখানে শিক্ষা উন্নয়ন একটি বিশাল ক্ষেত্র—শিক্ষানীতি, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, অবকাঠামো, পাঠ্যক্রম, মূল্যায়ন—কিন্তু সরকার সীমাবদ্ধ করে দিয়েছে “নোটবুক” এ।

এক্ষেত্রে বিরোধী দল বলতে পারে—

  • সরকারের সংজ্ঞা Tautology

  • আসল বিষয় “শিক্ষা উন্নয়ন”
    এবং নিজেরা নতুন সঙ্গায়ন স্থাপন করতে পারে।

 

 

সংসদীয় বিতর্কে এই শব্দগুলোর গুরুত্ব

এই শব্দগুলো শুধু তত্ত্ব নয়; এগুলো বিতর্কের ব্যবহারিক অংশ। একজন দক্ষ বিতার্কিক জানেন—

  • কবে সঙ্গায়ন অন্যায় হচ্ছে

  • কবে প্রস্তাবনা ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে

  • কবে একটি বিষয়কে বিতর্ক অযোগ্য করা হচ্ছে

Truism, Tautology, এবং Parallel Motion বোঝার অভাবের কারণে অনেক বিতর্কে অন্যায় সুবিধা নেওয়া হয়। আবার এই শব্দগুলো ভালোভাবে বুঝলে একজন বিতার্কিক—

  • বিতর্ককে সঠিক পথে আনতে পারে

  • যৌক্তিকতা রক্ষা করতে পারে

  • বিচারকের সামনে নিজের অবস্থান স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে

 

 

নতুন বিতার্কিকদের জন্য পরামর্শ

১. প্রস্তাবনা গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গায়ন মূল্যায়ন করুন।
২. যদি মনে হয় সঙ্গায়ন পক্ষপাতমূলক—নোট করুন।
৩. নিজের যুক্তি শুরু করার আগে বিচারককে বলুন কেন এটি Tautology/Truism।
৪. Parallel Motion তুললে দলগতভাবে সমন্বয় রেখে কথা বলুন।
৫. কখনও আবেগ ভিত্তিক যুক্তি ব্যবহার করবেন না; সবকিছুর যৌক্তিক ব্যাখ্যা দিন।

Truism, Tautology এবং Parallel Motion—এই তিনটি শব্দ সংসদীয় বিতর্কের ন্যায়পরায়ণতা নিশ্চিত করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এগুলোই ঠিক করে দেয় কোন সংজ্ঞা গ্রহণযোগ্য, কোন সংজ্ঞা বিতর্ককে অকার্যকর করে, এবং কোন অবস্থায় বিরোধী দল বিকল্প সঙ্গায়ন দিতে পারে। একজন দক্ষ বিতার্কিকের জন্য এগুলো জানা বাধ্যতামূলক, কারণ বিতর্কের মূল নীতি হলো—দুই পক্ষের সমান সুযোগ নিশ্চিত করা। এই শব্দগুলোর সঠিক প্রয়োগ বিতর্ককে শুধু নিয়মতান্ত্রিকই করে না, বরং আলোচনাকে আরও অর্থবহ, যুক্তিপূর্ণ ও প্রভাবশালী করে তোলে।

Leave a Comment