আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়ঃ বিতার্কিকের চোখে মহাকাব্য মহাভারত

বিতার্কিকের চোখে মহাকাব্য মহাভারত
বিশ্বের বৃহত্তম মহাকাব্য মহাভারত একজন বিতার্কিকের কাছে এক শিক্ষণীয় সম্পদ হতে পারে। বিতর্কে সাফল্যের মহাসূত্র হচ্ছে রণকৌশল বা স্ট্র্যাটেজি আর মহাভারত হচ্ছে রণকৌশল, নীতিবোধ, যুক্তি, বিচক্ষণতা ও প্রতিপক্ষকে মোকাবিলায় তাৎক্ষণিক বুদ্ধির এক জটিল এবং বৃহত্তম সংগ্রহ। এক বাঁধাধরা নিয়মে যুদ্ধ জয় সম্ভব নয়। এগারো অক্ষৌহিণী সৈন্যের নেতৃত্বে শতভ্রাতার কৌরব দল মাত্র পাঁচ ভ্রাতার নেতৃত্বে সাত অক্ষৌহিণী সৈন্য দলের কাছে শোচনীয় পরাজয় বরণ করেছিল। এটা বুদ্ধির জয়। পঞ্চপাণ্ডব ছিলেন সদ্য বন থেকে ফিরে আসা ভাসমান শরণার্থীর দল ।
পক্ষান্তরে শতপুত্রের কৌরবদল তখন রাজসিংহাসনে ক্ষমতাসীন। তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করা মানে হচ্ছে সমুদ্রে সাঁতার কাটতে কাটতে জাহাজের নৌসেনাদের সঙ্গে লড়াইয়ে লিপ্ত হওয়া। তারপরও পাণ্ডবরা জয়ী হলেন বলেই মহাভারত আজ প্রায় পাঁচ হাজার বছর ধরে এক অনবদ্য কৌতূহলের কাহিনি। এক অসামান্য শিক্ষার উৎস ।
এ লেখায় কিছু চরিত্র ও ঘটনাকে বিশ্লেষণ করা হবে, যা তর্কযুদ্ধের সমৃদ্ধি আনয়নে সহায়ক। মহাভারতের কাহিনি এখানে আনা সম্ভব নয় । সম্ভব নয় একটা বিতর্ক গ্রন্থে আরেকটি মহাভারতের সংকুলান। তথাপি সংক্ষপ্তি পটভূমির ছোঁয়া দিয়ে যুক্তিমূলক কথাগুলোকে মূল সলতেয় এনে কিছুটা প্রদীপ প্রজ্বলনের চেষ্টা করা হলো।
ভীষ্ম মানে প্রতিজ্ঞাশক্তি
তার্কিক হওয়ার প্রথম শক্তি প্রতিজ্ঞা। বিতার্কিক মানে ভীষ্মের মতো বীর হয়ে ওঠা। প্রাচীন ভারতের হস্তিনায় প্রতীপের পুত্র রাজা শান্তনু শিকারে বের হয়ে নদীর ধারে গঙ্গাদেবীর সাক্ষাৎ পান এবং তাকে রানি করার প্রস্তাব দেন । উত্তরে গঙ্গা শর্ত দেন যে স্ত্রী হিসেবে তাঁর কথাই চূড়ান্ত। বিয়ের পর সাত পুত্রকে গঙ্গা জলে নিক্ষেপ করেন ।
অষ্টম পুত্র দেবব্রতকে শান্তনু জীবিত রাখার পণ করায় গঙ্গা স্বর্গে চলে যান। গঙ্গা বিরহে শান্তনুর দিন যায়। এবার দেখা পান সত্যবতীর। বিয়ের প্রস্তাবে প্রতিপালক পিতা দাসরাজ ভবিষ্যতের সিংহাসনে সত্যবতীর পুত্রের অধিকার দাবি করায় শান্তনু বিষমচিতে ফিরে আসেন, কারণ গঙ্গাপুর দেবব্রতেরই তাঁর রাজ্যের পরবর্তী রাজা হওয়ার কথা।
দেবব্রত সব শুনতে পেয়ে নিজেই ঘোষণা দেন তিনি সিংহাসনও চান না এবং জীবনে বিয়েও করবেন না। এই ভীষণ প্রতিজ্ঞার কারণে তাঁর নাম হয় ভীষ্ম।

লক্ষ্যবিরোধ ও দ্বন্দ্বসূত্র
সত্যবতীর ঘরে চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য দুই পুত্র। রাজা চিত্রাঙ্গদের অকালমৃত্যুর পর বিচিত্রবীর্য রাজা হন, যার ছিল দুই পুত্র ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডু। জন্মান্ধ হওয়ায় ধৃতরাষ্ট্র রাজা হলেন না, হলেন কনিষ্ঠ পাণ্ডু। ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারীর ঘরে এল দুর্যোধন, দুঃশাসনসহ শতপুত্র ও দুঃশলা নামের এক কন্যা। এরাই কৌরবকুল। রাজা পাণ্ডু রানি কুন্তীর ঘরে যুধিষ্ঠির, ভীম ও অর্জুন এবং রানি মাদ্রীর ঘরে নকুল ও সহদেব নামে মোট পাঁচ পুত্রের জন্ম হয়। এরাই পাণ্ডবকুল। পাণ্ডু অকালে মরেন। স্ত্রী মাদ্রী ও সহমরণে যান। ভীষ্মের উপদেশমতো রাজ্য চলত। কথামতো সর্বজ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠির রাজা হবেন। কিন্তু দুর্যোধনের তা পছন্দ নয়। সে থেকেই পাণ্ডবদের প্রতি কৌরবদের হিংসা, রেষারেষি ও সবশেষে যুদ্ধ এবং বিনাশ যজ্ঞোত্তর মহান শিক্ষা। একজন বিতার্কিক কাহিনি গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পান কীভাবে সত্য-অসত্যের দ্বন্দ্ব স্পষ্টতর হয়ে ওঠে।
রণকৌশলী প্রধান বীরেরা
কৃপ ও দ্রোণ ছিলেন রাজপুত্রদের যুদ্ধ ও অস্ত্রবিদ্যার শিক্ষক। যোগ্য আচার্য পেলে উৎকৃষ্ট শিক্ষা লাভ করা যায়। তার প্রমাণ এই দুই আচার্য। তবে কৃপাচার্যের ভগ্নিপতি দ্রোণাচার্যই ছিলেন প্রধান শিক্ষক, যিনি সবচেয়ে বেশি পছন্দ করতেন অর্জুনকে। দ্বারকার রাজা শ্রীকৃষ্ণের বড় ভাই বলরাম ছিলেন দুর্যোধন ও ভীমের গদাশিক্ষক। কৃষ্ণ ছিলেন অর্জুনের বন্ধু—এক কথায় তিনিই হস্তিনার নিকটবর্তী কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধের মহানিয়ন্ত্রক। তাঁর বিচক্ষণতা, প্রজ্ঞা ও পরামর্শেই বড় বড় সব কাহিনির ভাগ্য নির্ধারিত হয়েছে।
শুধু তর্ক করলেই যেমন জয় আসে না, চাই যোগ্য রণকৌশল, ঠিক তেমনি ক্ষমতা থাকলেই যুদ্ধে বিজয়ী হওয়া যায় না, চাই সময়োচিত বিচক্ষণ পদক্ষেপ ও সূক্ষ্ম বুদ্ধির ব্রহ্মাস্ত্র । এ জন্য অর্জুনের সারথি হয়ে অর্থাৎ যুদ্ধ না করেও শ্রীকৃষ্ণ মহাভারতের সর্বোত্তম যোদ্ধা এবং সার্থক উদ্বুদ্ধকারী। একটা বিতর্ক দলের আড়ালেও এ রকম উপদেষ্টা থাকতে পারেন, যিনি বাগযুদ্ধে অবতীর্ণ না হয়েও দলের বিজয়ে মূল ভূমিকা রাখতে পারেন ।
এবার মহাবীর কর্ণের কথা। সূর্যদেবের মাধ্যমে কুন্তীর প্রথম পুত্র কর্ণ, যাকে কুম্ভী ফেলে দেন। অধিরথ সারথি ও তাঁর স্ত্রী রাধা কর্ণকে বড় করেন। লোকে জানে কর্ণ অধিরথ ও রাধার পুত্র। ছোটবেলা থেকেই সাধনা ও শিক্ষায় কর্ণ মহাবীর হয়ে ওঠেন। একদা যুদ্ধ করতে চান অর্জুনের সঙ্গে। দ্রোণ গুরু জানালেন, রাজা বা রাজপুত্র না হলে তা সম্ভব নয়। দুর্যোধন অর্জুনকে হিংসা করতেন বলে তিনি অঙ্গরাজ্য দান করে কর্ণকে রাজা বানালেন, হয়ে গেলেন কর্ণের বন্ধু। এটা বিতর্কে দলাদলির মতো। কে কাকে সুবিধা দিয়ে দলে টেনে নেবেন।
পঞ্চস্বামী মানে মাতৃআজ্ঞার যুক্তি
পাঞ্চালের রাজা দ্রুপদের মহাগুণবতী কন্যা দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর সভায় হাজির হয়েছিলেন বনবাসী পাণ্ডবগণ। কঠিন এক লক্ষ্যভেদের মাধ্যমে দ্রৌপদীকে জয় করতে হবে। শত বীরের দলে কর্ণও গেলেন। কিন্তু সারথিপুত্র হওয়ায় দ্রৌপদী তাকে লক্ষ্যভেদের সুযোগই দিলেন না। অন্যরা সবাই ব্যর্থ। কৃষ্ণা বা দ্রৌপদীকে জয় করলেন ব্রাহ্মণবেশী অর্জুন, যদিও অর্জুন আসলে ক্ষত্রিয়। পাণ্ডবগণ দ্রৌপদীকে সঙ্গে নিয়ে মা কুন্তীর কাছে বনের ঘরে এলেন। কিছু না দেখেই ঘরের মধ্য থেকে মা বললেন, যা এনেছ তা পাঁচজনে ভাগ করে নাও। মাতৃআজ্ঞা অলঙ্ঘনীয়। রাজা দ্রুপদ পাঁচ পাণ্ডবের কাছে দ্রৌপদীর বিয়ে দিলেন। দ্রৌপদীর পঞ্চস্বামী শুনতে অদ্ভুত। কিন্তু গড়িয়েছে যুক্তিতে। মায়ের কথা পালনের যুক্তি।
ক্রমাগত বিদ্যার্জনের নাম অর্জুন
যখন ধৃতরাষ্ট্র বুঝলেন তাঁর ছেলেদের ক্ষমতার উচ্চাভিলাষ এবং তা থেকে পাণ্ডবদের সঙ্গে বর্ধমান বিরোধ, তখন তিনি বিতর্কের বিজ্ঞ বিচারকের মতো পাণ্ডবদের ডেকে রাজ্য সমান ভাগ করে দিলেন। কৌরবেরা হস্তিনায় থাকলেন, পাণ্ডবেরা খাণ্ডবপ্রস্থকে বানালেন রাজধানী। ভালোই কাটছিল দিন। সেভাবে কাটলে যুদ্ধই হতো না আর মহাযোদ্ধাদের বীরত্ব দেখতে পেতাম না।
অর্জুন পাণ্ডব পক্ষের প্রধান বীর কোনো বিতর্ক দলে শ্রেষ্ঠ বক্তার মতো। কিন্তু কীভাবে এই বীর হয়ে ওঠা? অর্জুন জীবনের প্রতিটা স্তরে অর্জন করে গেছেন, তার চূড়ান্ত প্রতিফলন মাত্র আঠারো দিনের যুদ্ধে দেখা গেল । অনেক অধ্যয়ন ও চর্চার বলেই একজন ভালো বিতার্কিক, যার চূড়ান্ত প্রতিফলনের সময় মাত্র পাঁচ-সাত মিনিট কিংবা একটা টুর্নামেন্টের ব্যাপ্তি।
একবার বারো বছরের জন্য বনে গিয়ে অর্জুন মনিপুরের রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদাকে বিয়ে করেন। বিয়ে করেন নাগকন্যা উলুপীকেও। তারপর দ্বারকায় গিয়ে কৃষ্ণের বোন সুভদ্রাকে যাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি খাণ্ডবপ্রস্থে ফিরে এলেন। বিতর্কের মতো প্রশ্ন রয়ে গেল, অর্জুন উলুপী বা চিত্রাঙ্গদাকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরলেন না কেন? সুভদ্রাকে দেখে কেমন লেগেছিল দ্রৌপদীর?
কৃষ্ণ বেড়াতে এলেন খাণ্ডবপ্রস্থে। তখন অগ্নিদেবের সন্তুষ্টিতে কৃষ্ণার্জুন মিলে খাণ্ডবদাহন করে অর্জুন লাভ করলেন গাণ্ডীব ধনুক এবং অক্ষয় তৃণ, যা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ছিল এই বীরের প্রধান সহায়। যখন পেলেন জানতেন না একদিন এটা কাজে লাগবে। বিতার্কিকও তার জীবনে শেখার সময় বুঝতে পারবেন না কোন বিদ্যা কী কাজে লাগবে। অর্জুন দহন থেকে বাঁচিয়ে দিলেন ময় দানবকে। কৃতজ্ঞ দানব যুধিষ্ঠিরের জন্য বানিয়েছিলেন এক অপূর্ব সভা-ইন্দ্রপ্রস্থ।

উৎকর্ষের শিখরে
বিতর্ক শিক্ষা মানে ক্রমাগত শক্তি অর্জন। পাণ্ডবেরাও সে পথে গেলেন। দেবর্ষি নারদের উপদেশে ঐশ্বর্যের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি মানে রাজসূয় যজ্ঞ করলেন। বাধা এল অনেক। ভীম আর অর্জুনের বীরত্বে যজ্ঞের প্রতিপক্ষ পরাভূত হলো । বিতর্কের সমৃদ্ধ বিষয়বস্তুর মতো অনেক ধনরত্ন সংগ্রহ করতে হলো তাদের। চূড়ান্ত বিতর্কে শ্রেষ্ঠ বক্তার মুকুট পাওয়ার স্বীকৃতির মতো ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির হলেন ভারতের সর্বস্বীকৃত সম্রাট। ভীষ্মের মূল্যায়নে শ্রীকৃষ্ণ পেলেন সর্বোচ্চ শ্রদ্ধার অর্ঘ্য, যদিও বয়েসে তিনি তখনো অনেকের চেয়ে ছোট। ভীষ্ম একজন অসামান্য বিচারক, সমস্ত মহাভারতে সবচেয়ে সংগতিপূর্ণ নীতিমান বীর ।
ধর্মপুত্রের নীতিবিপর্যয় ও দ্রৌপদীর দুরবস্থা
বিতর্কের চোখে যুধিষ্ঠিরকে আগাগোড়া ধর্মপুত্র হিসেবে দেখা কঠিন। কারণ বিতার্কিক অলৌকিকত্ব, অদৃষ্টবাদ বা আধ্যাত্মিকতায় আবিষ্ট হয়ে যুক্তি দাঁড় করাতে পারেন না। পাণ্ডবদের চরম উন্নতি, ঐশ্বর্য ও সম্মানে সহিংস হয়ে উঠলেন দুর্যোধন ও দুঃশাসন। তাঁদের মামা শকুনির কুপরামর্শে পাশা খেলায় ডাকলেন যুধিষ্ঠিরকে । প্রথমত, এ ডাক গ্রহণ করা উচিত হয়নি যুধিষ্ঠিরের। বীর শুধু তার শক্তিই বোঝে না, বোঝে দুর্বলতাও।
শকুনিকে হারানো কঠিন। তদুপরি এর অন্তর্নিহিত ষড়যন্ত্র বোঝার ক্ষমতা ছিল পাণ্ডবদের। তারপরও নীতির নামে ফাঁদে পা দিলেন। অথচ পুরো মহাভারতে সব জায়গায় এ নীতিবোধ অবিচল ছিল না। সে কথা পরে আসবে। আরও অন্যায় করলেন যুধিষ্ঠির। ধন-রত্ন- রাজ্য সব হারিয়ে ভাইদের বাজি ধরলেন । সেটাতেও হারলেন। অন্যায় করলেন স্ত্রী দ্রৌপদীকে বাজি ধরে। কারণ দ্রৌপদীর ওপর আরও চার স্বামীর অধিকার আছে। জ্যেষ্ঠত্বের অধিকারে তিনি আরও চার ভ্রাতার প্রিয়তমাকে রাজসভায় বাজির বন্ধ করতে পারেন না।
দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণের চেষ্টায় দুঃশাসন কতই না তাকে লাঞ্ছনা করলেন। নারীত্বের অপমান মানবতার অপমান। সেদিন একমাত্র ভীম প্রতিবাদ করে প্রতিজ্ঞা করলেন তিনি একাই কৌরবকুল সংহার করবেন। তারপর দুঃশাসনের বুকের রক্ত পান করার প্রতিজ্ঞা। সেদিন কেন নীরব ছিলেন কৃষ্ণা জয়ী মহাবীর অর্জুন? এ যেন বিতর্কে দলনেতার ভুলে সহবক্তাদের ভুল বৃদ্ধির অনিবার্যতা। 1 ধৃতরাষ্ট্র ভয় পেয়ে সবাইকে দাসত্বপণ থেকে মুক্তি দিলেন। কিন্তু আবার পাশা খেলার ফাঁদে পড়লেন যুধিষ্ঠির। এবার হেরে বারো বছর বনবাস এবং এক বছর অজ্ঞাতবাসের শাস্তি পেলেন। তবে পাণ্ডবদের বিচারে এটি শাস্তি নয়, এটি সংগ্রাম শেখার সুযোগ, এটি বিচিত্র অভিজ্ঞতা অর্জনের পথ, এটি শক্তিসাধনার অপূর্ব সুবিধা, যার বলে তাঁরা পরবর্তী সময়ে কুরুক্ষেত্রে বিজয়ী হতে পেরেছিলেন।
বহুগুণেই বীরত্বের বিকাশ
সমস্ত মহাভারতের নীরব গ্রন্থিক পণ্ডিত ব্যাসদের যিনি পরে গণপতিকে দিয়ে এই মহাকাব্যটি লিপিবদ্ধ করান। প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে তাঁর উপস্থিতি। নীতি ও ধর্মের সংরক্ষণে তিনি কাজ করতেন। পাণ্ডবরা কাম্যক বনে চলে যাওয়ার পর অর্জুনকে উদ্বুদ্ধ করলেন শিবের তপস্যা করতে। এ সাধনায় অর্জুন লাভ করেন পাশুপত নামে এক মহাস্ত্র। দেবরাজ ইন্দ্রকে সহায়তা করতে গিয়ে দানবরাজ নিবাত কবচ নিধন করেন।
ইন্দ্র, বরুণ, যম, কুবের প্রমুখ দিলেন আরও অস্ত্র। এ সময় স্বর্গে বসে তিনি নৃত্যগীতসহ নানাবিধ সংস্কৃতি অনুশীলন করেন, যে গুণ তাঁর পরে কাজে লেগেছিল। অর্জুন শেখালেন যে একজন বীর শুধু ধনুর্বিদ্যা শিখবেন না—নানা গুণে সম্পন্ন মানুষ হয়ে উঠবেন। এ শিক্ষা সব বিতার্কিকের জন্যও প্রযোজ্য। আবৃত্তি, সংগীত, অভিনয়শিল্প তর্কশিল্পকে সমৃদ্ধ করে বৈকি!

বুদ্ধিমন্থন ও অজ্ঞাতবাসের কৌশল
বারো বছর বনবাস শেষে এক বছর অজ্ঞাতবাসের চিন্তা পাণ্ডবদের কাতর করল । কারণ ধরা পড়লে আবারও বারো বছরের বনবাস। বিতর্ক প্রস্তুতির সময় প্রতিপক্ষের কঠিন যুক্তি মোকাবিলার কৌশল নির্ধারণে শুরু হয় বুদ্ধিমন্থন, মেধা ঝড় বা ব্রেইন স্টরমিং। যুধিষ্ঠিরের নেতৃত্বে পাণ্ডবরাও তা-ই করলেন। তাদের মধ্যে অর্জুনকে নিয়েই বেশি চিন্তা। যেকোনো সৈনিকের চাকরিতে তাকে ধরে ফেলা সম্ভব।
কম্বল দিয়ে হয়তো ছোটখাটো আগুন নেভানো সম্ভব, অগ্ন্যুৎপাত চাপা দেওয়া যায় না। সিদ্ধান্ত হলো তাঁরা সবাই বিরাটনগরের রাজপরিবারের আশ্রয় নেবেন। যুধিষ্ঠির হলেন কঙ্ক নামে রাজসভাসদ ও রাজার পাশাসঙ্গী। দ্রৌপদী সৈরেজী নাম নিয়ে রানি সুদেষ্ণার সহচরী। ভীম বল্লভ নামের রাজপাচক অর্জুনকে চেনারই উপায় নেই। নারীবেশে বৃহন্নলা নাম নিয়ে অন্দরমহলে রাজকুমারী উত্তরা ও তাঁর সখীদের নাচ-গানের শিক্ষক। রাজার অশ্ব ও গোশালার ভার পেলেন গ্রন্থিক নামধারী নকুল ও তন্ত্রীপাল নামধারী সহদেব।
যুদ্ধ ও শিষ্টাচার
বিতর্ক একটা বাগযুদ্ধ, কিন্তু বক্তাকে শিষ্টাচারের যোগ্য প্রমাণ দিতে হয়। তেমনটি দিয়েছিলেন অর্জুন। পাণ্ডবদের এক বছরের অজ্ঞাতবাস সবে শেষ হয়েছে। কৌরবকুল বিরাটরাজ্যে আক্রমণ করে বসলেন। রাজপুত্র উত্তর ততটা দক্ষ রণবিদ নন ৷ তিনি অগত্যা বৃহন্নলারূপী অর্জুনকে সারথি হিসেবে নিলেন কিন্তু অর্জুন নিজেই যোদ্ধা হলেন। প্রতিপক্ষে দাঁড়িয়ে আছেন তাঁরই শিক্ষক দ্রোণাচার্য ও পিতামহ ভীষ্ম ।
অর্জুন প্রথমে দুটো বান মারলেন, যা এসে দ্রোণের পায়ের কাছে মাটিতে বিধে গেল। অর্থাৎ গুরু আপনাকে প্রণাম। তারপর দুটো বাণ দ্রোণের কানের দুই পাশ দিয়ে উড়ে গেল। অর্থাৎ আপনি কেমন আছেন? দ্রোণাচার্য বুঝে গেলেন প্রতিপক্ষের নারীরূপী যোদ্ধা তাঁর এককালের প্রিয় ছাত্র অর্জুন ৷ কিন্তু যুদ্ধ তো করতেই হবে। অর্জুন হারালেন কৌরবকুলকে। শুভদিনে পঞ্চভ্রাতা ও দ্রৌপদী আত্মপ্রকাশ করলেন। আনন্দে আত্মহারা রাজা বিরাট কন্যা উত্তরার বিয়ে দিলেন অর্জুন ও সুভদ্রার বীরপুত্র অভিমন্যুর সঙ্গে।
পাণ্ডবদের উদ্বুদ্ধকরণ ও কৌরবদের যুদ্ধদৃঢ়তা
কোনো উদ্যোগ বা মত প্রতিষ্ঠার চেষ্টা ব্যর্থ বা সফল হবে কি না এগুলোর চিন্তায় আচ্ছন্ন হওয়া অনুচিত। বিতার্কিককে উদ্বুদ্ধকরণের কাজ চালিয়ে যেতেই হয় কথায়, বক্তৃতায় কিংবা লেখনিতে। পাণ্ডবগণ তেরো বছর পর হস্তিনায় ফিরে রাজ্য ফেরত পাওয়ার জন্য সে কাজটিই করলেন। পুরোহিত ধৌম্যকে সমঝোতার কূটনৈতিক উদ্যোগ নিতে বলা হলো। তারপর পাণ্ডবদের কাকা মহামতি বিদুর, ভীষ্ম, দ্রোণ এমনকি রাজা ধৃতরাষ্ট্র পর্যন্ত সংঘাতের কুফল তুলে ধরলেন তার্কিকের মতো অজস্র যুক্তিপ্রমাণ দিয়ে। তার আগের যুগেই তো রাক্ষসপতি রাবণের পতন হলো। কিন্তু দুর্যোধন সংঘাত সৃষ্টির দৃঢ়তায় অটল থেকে যুদ্ধকে করে তুললেন অনিবার্য ।
গুণগ্রাহিতা ও বিনয়ের প্রাপ্তি তর্কযুদ্ধেও বিনয়ের সুফল আছে। কারণ ‘বিদ্যা দদাতি বিনয়ং। দুই পক্ষে শুরু হলো ভারতবর্ষের সমস্ত রাজাদের নিয়ে টানাটানি। কতগুলো আগেই ঠিক ছিল, যেমন পাঞ্চালের রাজা দ্রুপদ আর মৎস্যদেশের রাজা বিরাট আত্মীয়তার সূত্রে পাণ্ডবপক্ষে আসবেনই। কৌরবদের আত্মীয়ই বেশি। শ্রীকৃষ্ণকে আনতে গেলেন দুর্যোধন, বসলেন গিয়ে নিদ্রিত দ্বারকাপতির মাথার কাছে এক সিংহাসনে। বিনয়াবনত অর্জুন গিয়ে বসলেন কৃষ্ণের পায়ের কাছে বিছানার কোণে। ঘুম থেকে উঠেই শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে দেখলেন প্রথমে, সুতরাং কিছু চাইবার বেলায় অর্জুন অগ্রাধিকার পেলেন।
একদিকে শ্রীকৃষ্ণ শুধু একা এবং তিনি যুদ্ধ করবেন না। অন্যদিকে দুর্ধর্ষ নারায়ণী সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী । অর্জুন নিলেন শুধু কৃষ্ণকে। দুর্যোধন নারায়ণী সেনাদল পেয়েও খুশি। তিনি তখনো বুঝতে পারেননি যে একজন যোগ্য উপদেষ্টার বুদ্ধিবল এক অক্ষৌহিণী সেনা দলের ক্ষমতার চেয়ে বেশি। একজন উপদেষ্টা একটা বিতর্ক দলের দৈন্যদশা ঘুচিয়ে তাদের ভাগ্য পাল্টে দিতে পারে। সে জন্য চাই গুণগ্রাহিতা ও শ্রদ্ধাবোধ, কারণ শ্রদ্ধাবান লভতেঃ জ্ঞানম

উদ্বুদ্ধকরণ ও কর্ণের দৃঢ়তা
যুদ্ধে ধনসম্পদ ও জীবন নাশ—এ কথা ভেবে ব্যথিত যুধিষ্ঠির। যুদ্ধ এড়ানোর উদ্বুদ্ধকরণে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের শিষ্য মহাবীর সাত্যকিকে সঙ্গে নিয়ে কৌরবসভায় এলেন । পাঁচ ভাইয়ের জন্য রাজত্ব নয়, মাত্র পাঁচখানি গ্রাম চাইলেন । দুর্যোধনের উত্তর, ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দেব সূচাগ্র মেদিনী।’ ব্যর্থ হলো কূটনীতি । এবার শ্রীকৃষ্ণ সংগোপনে কর্ণকে বললেন, যুধিষ্ঠিরের বড় ভাই হিসেবে তুমিই রাজা হবে । চলে এসো পাণ্ডব পক্ষে।’ কৃতজ্ঞতায় দুর্যোধনের দিকে অটল রইলেন নীতিবাদী কৰ্ণ । এক পর্যায়ে লুকিয়ে কুস্তীও দেখা করেন কর্ণের সঙ্গে।
সংক্ষুব্ধ কৰ্ণ পাণ্ডবপক্ষে আসতে অসম্মতি জানালেন। বরং একদিন কুম্ভী তাকে যে অনাদরে ফেলে দিয়েছিলেন সে কথাও উল্লেখ করলেন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় কর্ণ সেদিন তাঁর মাকে এভাবে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, জয় লোভে, যশলোভে, রাজ্য লোভে অগ্নি/ বীরের সদগতি হতে ভ্রষ্ট নাহি হই।’
বিতার্কিকেরা বিশ্বাস করে উদ্বুদ্ধকরণের সুফল কিছু পাওয়া যাবেই। কুন্তিও খালি হাতে ফেরেননি। কর্ণ কথা দিলেন পাণ্ডবদের মধ্যে চার ভাইকে তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণে মারবেন না। কিন্তু অর্জুনকে তিনি ছাড়বেন না।
যুদ্ধের দলপতিত্ব
অধিক সৈন্য ও বীরের উপস্থিতিতে কৌরব পক্ষ জমজমাট। কিন্তু বিতর্কের সবচেয়ে ভালো কাউকে দলনেতৃত্ব দিতে হবে। এক কথায় ঠিক হলো ভীষ্ম হবেন সেনাপতি। কিন্তু তাঁর স্পষ্ট জবাব । যুদ্ধ তিনি করবেন করতে হয় বলে । বীরত্বের কর্তব্যে প্রতিপক্ষের সৈন্য সংহার করে যাবেন ক্রমাগত। তবে কোনো পাণ্ডবকে তিনি প্রাণে মারবেন না। ভীষ্মের মাপের বীর পাওয়া কঠিন।
তাই অর্জুন সরাসরি পাণ্ডবপক্ষের সেনাপতি হলেন না। সেনাপতি করা হলো বিরাট, সাত্যকি, দ্রুপদ, শিখণ্ডী, ধৃষ্টকেতু জাতীয় সাতজনকে আর দ্রৌপদীর ভ্রাতা ধৃষ্টদ্যুম্ন হলেন প্রধান সেনাপতি। আবার এদের সবার পরিচালক হলেন অর্জুন, যার প্রধান উপদেষ্টা শ্রীকৃষ্ণ। এ যেন অনেকটা তিন স্তরের নেতৃত্ব বিন্যাস ও যুদ্ধ মোকাবিলা সংগঠনের বিন্যাস ও বুদ্ধির প্রয়োগ যে রণকৌশল দেয় তা প্রত্যক্ষ ক্ষমতা অপেক্ষা অধিক কার্যকর, পাণ্ডবপক্ষ তাই প্রমাণ করল ।
ভীষ্ম ও গান্ধারীর আশীর্বাদ
যুদ্ধ শুরুর ঠিক আগে যুধিষ্ঠির এক আশ্চর্য কাজ করলেন। রথ ছেড়ে পায়ে হেঁটে প্রতিপক্ষের এলাকায় গিয়ে সেনাপতি ভীষ্ম, গুরু দ্রোণ ও কৃপের আশীর্বাদ চাইলেন। সৌজন্য আর মহত্ব দিয়ে প্রতিপক্ষকে দুর্বল করে দিলেন প্রথমেই । ভীষ্ম নীতিমান । তিনি আশীর্বাদ করে বললেন, ‘যুদ্ধ আমি কৌরবপক্ষে থেকে করলেও জয় হবে তোমাদের। কারণ ধর্ম তোমাদের পক্ষে। যুদ্ধ শুরুর আগে মাতা গান্ধারীর আশীর্বাদ নিতে গিয়েছিলেন তাঁর পুত্ররা। তখন গান্ধারী কখনো বলেননি ‘তোমাদের জয় হোক। বলেছিলেন, ‘ধর্মের জয় হোক।’ নীতিবোধে ভীষ্ম ও গান্ধারীর একাকার। দুজনের কেউই অনৈতিক যুদ্ধ মেনে নিতে পারেননি। যুধিষ্ঠিরের সৌজন্য শক্তি উদ্বুদ্ধকরণের এক হাতিয়ার। জীবনযুদ্ধেও আমরা এই সৌজন্যের অসামান্য ক্ষমতায় উপকৃত হই।
কৃষ্ণের উদ্বুদ্ধকরণ ও গীতার উৎপত্তি অর্জুন প্রতিপক্ষের আত্মীয়স্বজন দেখে যুদ্ধ করার বাসনা ত্যাগ করলেন ৷ স্বজন হত্যার পর সিংহাসন লাভে কি আসে যায়? ফেলে দিলেন ধনুবীণ। তখন শ্রীকৃষ্ণ সারথির আসনে বসে অর্জুনকে নানাভাবে বুঝিয়ে এই অনিবার্য যুদ্ধে সম্মত করান। তাঁর এই উপদেশমালা মানেই শ্রীগীতা। বীরের ধর্ম যুদ্ধ করা এবং তা ন্যায়সংগত ধর্মের পক্ষে। কৃষ্ণ আরও বলেন, ‘তুমি কর্ম করে যাও। ফলের চিন্তা তোমাকে করতে হবে না। তুমি তো যুদ্ধ শুরু করাগুনি। যুদ্ধ হয়ে উঠেছে অনিবার্য । এখন রণভঙ্গ দেওয়া বীরের ধর্ম নয়। এ রণভঙ্গ হবে মমতার দুর্বলতায় অন্যায়ের জয়। তা একজন বীর হতে দিতে পারে না। ফলের লোভ না করেই বীর হবে কর্মযোগী।
শ্রীকৃষ্ণের এসব শিক্ষা প্রমাণ করে যে যুক্তির সাথে উদ্বুদ্ধকরণ সম্পন্ন করলে অনেক কঠিন সিদ্ধান্তকেও পাল্টে দেওয়া যায়। উদ্বুদ্ধকরণ দিতে পারে নবউদ্যমের শক্তি। তারই বলে অর্জুন নতুন তেজস্বিতায় যুদ্ধ শুরু করেন। যেন তাঁর পুনর্জন্ম হলো নব শক্তিতে, বীর্যে ও প্রজ্ঞায়। শুরু হলো ভীষ্মের সাথে মহারণ। সফলতা পেলেন উদ্বুদ্ধকারী বক্তা শ্রীকৃষ্ণ।

ভীষ্মের পরাজয় ও নীতিনিষ্ঠার শিক্ষা
অর্জুন আর ভীষ্মের বাণে বাণে আকাশ অন্ধকার । কোনোভাবেই পরাস্ত করা যাচ্ছে না তাকে। পিতা শান্তনু তুষ্ট হয়ে বর দিয়েছিলেন ইচ্ছামৃত্যু । কার সাধ্যি ভীষ্মকে টিলায়। গভীর রাতে পাণ্ডবেরা ভীষ্মের কাছে গিয়ে কাতরভাবে বললেন যে ভীষ্ম যদি নিজে থেকে কোনো কৌশল বাতলে না দেন তাহলে পাণ্ডবদের পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছে না এই মহাবীরকে ঠেকানো। ভীষ্ম পাণ্ডবপক্ষকে নৈতিকতার পক্ষ মনে করতেন।
তাই নিজেই বলে দিলেন তাকে দমানোর কৌশল। পরদিন সেই কথামতো শিখণ্ডীকে বসানো হলো অর্জুনের রথের সামনে। তাকে দেখে ভীষ্ম অস্ত্র ত্যাগ করলেন ৷ তাকে বাণে বাণে জর্জরিত করে ফেললেন অর্জুন । এক সময় ভীষ্ম রথ থেকে পড়ে গেলেন, কিন্তু তাঁর শরবিদ্ধ দেহ মাটি স্পর্শ করল না। শরশয্যায় ভীষ্ম শায়িত রইলেন কিন্তু ইচ্ছামৃত্যুর ক্ষমতাবলে জেগে রইলেন যুদ্ধের শেষ দেখে যাবেন বলে।
ভীষ্ম কেন যুদ্ধ থামালেন? একবার ভীষ্ম তাঁর ভাই বিচিত্রবীর্যের জন্য অম্বা, আম্বিকা ও অম্বালিকা নামে তিন রাজকন্যাকে রথে তুলে নিয়ে এলেন। অস্বা বললেন, আমি রাজা শাখকে ভালোবাসি। ভীষ্ম তাকে ছেড়ে দিলেও শাৰ অম্বাকে গ্রহণ করলেন না। দুঃখে অপমানে অম্বা তপস্যা শুরু করলেন যেন তিনি ভীষ্মের বিনাশ আনতে পারেন। সাধনার জোরে দ্রুপদের ঘরে তাঁর জন্মলাভ। যাকে দেখলে ভীষ্ম নৈতিকভাবে যুদ্ধ করতে পারেন না। মহাভারতে অনেক বীর যুদ্ধে নীতি পরিবর্তন করলেও ভীষ্ম আগাগোড়া নীতিতে অবিচল।
দ্রোণের কূটকৌশল
ভীষ্মের শরশয্যার পর দ্রোণাচার্য হলেন সেনাপতি। দুর্যোধনের বুদ্ধিতে এক ফন্দি আঁটলেন – যুধিষ্ঠিরকে আলাদা করে ধরে আনতে হবে এবং পাশা খেলিয়ে আবার বনে পাঠানো হবে। কিন্তু ভীমার্জুন থাকতে তা সম্ভব নয়। প্রোণ পঞ্চাশজন বীর ও পঞ্চাশ হাজার সৈন্য দিয়ে ‘সংশপ্তক’ নামে এক নতুন দল গঠন করলেন। অর্জুনকে ব্যস্ত রাখার ব্যবস্থা করা হলো। কিন্তু অর্জুন ত্বাষ্ট অস্ত্রে সংশপ্তকদের পরাস্ত করেন। যুধিষ্ঠিরকে ছিনিয়ে নেওয়ার কূটকৌশল আর সফল হলো না। যুধিষ্ঠির ছিনতাইয়ের এই কৌশল কাজ না করলেও পরদিন দ্রোণাচার্য চক্রব্যূহ রচনা করে আরেকটি ফাঁদ সৃষ্টি করলেন।
অভিমন্যু বধ নাকি বিপর্যয়ের সূচনা
দ্রোণ নারায়ণী সেনা দিয়ে অর্জুনকে অন্যদিকে নিয়ে গেলেন। তখন অর্জুন ও সুভদ্রার যোদ্ধাপুত্র অভিমন্যু ছাড়া আর কেউ চক্রব্যূহে প্রবেশ করার যোগ্য রইলেন না। অভিমন্যু ঢুকতে শিখেছিলেন কিন্তু বেরুতে শেখেননি। ভীমের আশ্বাসে ব্যূহে ঢুকে গিয়ে মহারণ শুরু করলেন। দুর্যোধনের ভগ্নিপতি জয়দ্রথ ব্যূহের দ্বার রক্ষা করলেন। শিবের বরে তিনি অর্জুন ছাড়া সব পাণ্ডবকে পরাস্ত করার ক্ষমতা রাখতেন ।
ভীমকে জয়দ্রথ প্রতিহত করলেন ৷ ব্যূহ অভ্যন্তরে বালক অভিমন্যু এমন যুদ্ধ শুরু করলেন যে দ্রোণ কৃপ বা কর্ণ কেউই তাকে এককভাবে পরাভূত করতে পারলেন না। যুদ্ধনীতি ছিল দুই মহারথীর মধ্যে যুদ্ধ চলতে থাকলে তৃতীয় মহারথী এসে কোনো পক্ষকে আক্রমণ করতে পারবেন না, ঠিক যেন বিতর্ক নিয়মের মতো। কিন্তু নীতি বিপর্যয়ের সূচনা হলো শকুনির রূপরামর্শে। সপ্ত মহারথী মিলে একসঙ্গে আক্রমণ করে অভিমন্যুকে বধ করলেন। শুরু হলো নীতি বিপর্যয়ের আরেক অধ্যায়, যা কৌরবদের জন্য বুমেরাং হয়েছিল ।
প্রতিজ্ঞা ও কৌশলের জয়
অর্জুন প্রতিজ্ঞা করলেন আগামীকাল সূর্যাস্তের আগে জয়দ্রথকে বধ করতে না পারলে তিনি নিজেই অগ্নিতে প্রবেশ করবেন। কালো মেঘ সূর্য ঢেকে দিল । অর্জুন অগ্নি প্রদক্ষিণ করছেন। আনন্দিত কৌরবেরা দর্শক। হঠাৎ মেঘ সরে গেল। সূর্যাস্ত হয়নি। কাছেই ছিলেন জয়দ্রথ, যাকে অর্জুন বধ করলেন। পালিত হলো প্রতিজ্ঞা। কর্ণ মহারণ শুরু করলেন। কিন্তু কৃষ্ণ অর্জুনকে সেখানে যেতে দিলেন না। কারণ কর্ণের হাতে ছিল ইন্দ্র প্রদত্ত ‘এক পুরুষঘাতিনী’ অস্ত্র, যা অপ্রতিরোধ্য—একজনকে হত্যা করবেই— সে যত বড় বীর হোক। কিন্তু সেটি একবারই প্রয়োগ করা যাবে।
কৃষ্ণ চাইতেন কর্ণ এ অস্ত্রটি শেষ করে ফেলুক। তাই তিনি ভীম ও রাক্ষসী হিড়িম্বার পুত্র মহাবল ঘটোৎকচকে কর্ণের মোকাবিলায় পাঠালেন। কর্ণ বাধ্য হলেন এক পুরুষঘাতিনী” প্রয়োগ করে ঘটোৎকচ বধ করতে। কৌশলে দুর্বল করা হলো কর্ণকে। কর্ণের বাকি অস্ত্রগুলোর জবাব দেওয়ার মতো অস্ত্র অর্জুনের ছিল।
কূটকৌশল ও দ্রোণাচার্য বধ
সবাই তো দ্রোণের ছাত্র। কে তাকে বধ করতে পারবে। একবার পাণ্ডবপক্ষ দ্রোণের কাছে তাঁর মৃত্যুসূত্র জানতে চায়। দ্রোণ বলেছিলেন যে স্বাভাবিক যুদ্ধে তাকে পরাস্ত করা অসম্ভব । তিনি সৎ লোকের কথায় বিশ্বাস করেন। এই কৌশলে ভীম ‘অশ্বত্থামা’ নামে এক হাতি মেরে সশব্দে তার ঘোষণা দেন। ছাত্র যুধিষ্ঠিরের কাছে দ্রোণ এর সত্যতা জানতে চাইলে যুধিষ্ঠির ‘হ্যাঁ’ বলেন, যদিও আস্তে করে বলেন ‘হাতি’। দ্রোণ ভাবলেন তাঁর পুত্র অশ্বত্থামা মারা গেছেন। পুত্রশোকে ভেঙে পড়েন দ্রোণ। যুদ্ধক্ষেত্রে অস্ত্র ত্যাগ করলে ধৃষ্টদ্যুম্ন তাকে বধ করেন।
পিতৃশোকে ক্রোধান্বিত অশ্বত্থামা পাণ্ডববিধ্বংসী নারায়ণ অস্ত্র’ ছুড়লেন। অর্জুনেরও সাধ্য নেই তা মোকাবিলা করার। শ্রীকৃষ্ণ নিজেই নারায়ণ। তিনি পাণ্ডবদের অস্ত্র ত্যাগ করে দাঁড়াতে বললেন এবং নিজেই অশ্বত্থামার অস্ত্র প্রতিরোধে বুক পেতে দিলেন। ‘নারায়ণ অস্ত্র’ তাঁর কাছে এসে গলার মালা হয়ে নিঃশেষিত হলো ।

কর্ণসংহার ও শেষ দুর্গের পতন
দ্রোণের বিদায়ে এবার কর্ণের সেনাপতি হওয়ার পালা। তিনি যোদ্ধা শল্যকে চাইলেন রথের সারথি হিসেবে। শল্য এটা নিলেন অপমান হিসেবে। কারণ তিনি সেনাপতি হওয়ার যোগ্য। সারথি নয়। পাণ্ডবদের প্রতি শল্যের মমতা ছিল, কারণ তিনি নকুল-সহদেবের আপন মামা। শল্য সারথি হলেন ঠিকই, কিন্তু পদে পদে নানা কথায় কর্ণকে নিস্তেজ করে দিলেন। অর্থাৎ উৎসাহের ভূমিকা আছে জয়ে আর নিরুৎসাহের প্রভাব আছে পরাজয়ে।
এদিকে দুঃশাসনকে কাছে পেয়ে ভীম দ্রৌপদীর অপমানের কথা স্মরণ করিয়ে তাকে হত্যা করলেন- প্রতিজ্ঞাও রাখলেন। কর্ণের এক ভয়ানক বাণ অর্জুন প্রতিরোধ করতে পারবেন না জেনে কৃষ্ণ রথের চাকা দাবিয়ে দিলেন। বাণটি অর্জুনের মুকুট চূর্ণ করে চলে গেল। শুরু পরশুরামের অভিশাপে কর্ণের রথের চাকা মাটিতে বসে গেল। কর্ণ তা তুলতে চেষ্টা চালাচ্ছেন এবং অর্জুনকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন যে বিপন্ন শত্রুকে আঘাত করতে নেই। অভিমন্যুকে কাপুরুষোচিতভাবে হত্যা করার উদাহরণ টেনে অর্জুন অঞ্চলিক বাপে ভীষ্মের মাথা কেটে ফেললেন। কৌরবকুলের তিন প্রধান দুর্গই ধসে গেল ।
শল্য ও দুর্যোধন বিনাশ
ভীষ্ম, দ্রোণাচার্য ও কর্ণের বিদায়ে দুর্যোধন বুঝে গেলেন সব শক্তি শেষ। দুর্যোধন অবশেষে উপলব্ধি করলেন যে পাণ্ডবপক্ষের ক্ষমতা হচ্ছে বুদ্ধি, বিচক্ষণতা আর রণকৌশলে । তিনি শেষ সম্বল শল্যকে সেনাপতি বানালেন। শল্য আগের মাপের সেনাপতিদের মতো ছিলেন না। মারা গেলেন যুধিষ্ঠিরের ‘শক্তি’ অস্ত্রে। সহদেবের ‘ভয়’ অস্ত্রে মাথা কাটা গেল কুপরামর্শদাতা শকুনির। অন্যের ক্ষতি করার পরামর্শ গ্রহণ করা বীরোচিত কর্ম নয়। শকুনির বুদ্ধিতে কৌরবকুলের সর্বনাশ। তার্কিকেরাও সবার উপদেশ নেন না। নিলেও যাচাই করেন।
এবার দ্বৈপায়ন হ্রদের নিচে এক বিশ্রামকক্ষে দুর্যোধন লুকিয়ে রইলেন। কৃষ্ণের বুদ্ধিতে তাকে ডেকে এনে গদাযুদ্ধে লিপ্ত হলেন ভীম। দুজনেই গদায় মহাযোদ্ধা । এই প্রধান যুদ্ধংদেহী অন্যায়কারীকে ভীম আর বাঁচিয়ে রাখতে চান না । গদার নিয়ম ভেঙে ভীম দুর্যোধনের উরুতে আঘাত করে তা ভেঙে দিলেন। প্রতিবাদ করেছিলেন বলরাম, কারণ তিনি যে দুজনেরই শিক্ষক-এক নিরপেক্ষ বিতর্ক বিচারক। ধীরে ধীরে মৃত্যুবরণ করলেন মহাবীর দুর্যোধন ।
অর্জুন-অশ্বত্থামার শেষ যুদ্ধ
মৃত্যুর আগে দুর্যোধন শেষ সেনাপতি করে যান দ্রোণপুত্র মহাবীর অশ্বত্থামাকে। কৃষ্ণের পরামর্শে সেদিন পঞ্চপাণ্ডব আর শিবিরে ঘুমালেন না। গাছের নিচে শুয়ে নিদ্রাহীন অশ্বত্থামা দেখলেন একটি পেঁচা এসে ঘুমন্ত কাকগুলোকে বধ করতে আক্রমণ চালাল। এ দৃশ্যে তিনি এক অবীরোচিত কৌশল শিখলেন। গভীর রাতে কৃপাচার্য ও কৃতবর্মাকে সঙ্গে নিয়ে ঘুমন্ত প্রতিপক্ষের ওপর আক্রমণ করে পঞ্চপাণ্ডবের পাঁচ পুত্র, তাঁর পিতৃহন্তা খৃষ্টদ্যুম্ন, ভীষ্মের নিষ্ক্রিয়তার কারণ সেই শিখণ্ডী ও অন্যান্য বীরকে পশুর মতো হত্যা করলেন।
পরদিন ভীষণ যুদ্ধে প্রায় পরাস্ত হওয়ার আগে অশ্বত্থামা ‘ব্রহ্মশির’ অস্ত্র ছুড়লেন—জবাবে অর্জুন ছুড়লেন `মহাদি ব্যাস্ত্র’। এই দুই মহা অস্ত্রের প্রভাবে সৃষ্টি যায় রসাতলে। দেবতারা মধ্যস্থতা করে অশ্বত্থামার মাথার মণি নিয়ে নিলেন—খর্ব হয়ে গেল তাঁর সমস্ত তেজ ও শৌর্য । কোথায় যে গেলেন তিনি কেউ তা জানল না। আঠারো দিন পর কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধের সমাপ্তি ঘোষিত হলো। শুরু হলো কান্না আর শান্তি অন্বেষণের পালা।
গান্ধারী ও ধৃতরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া
শতপুত্র হারিয়ে তাদের ভালো থাকার কথা নয়। ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ বলে বিয়ের পর গান্ধারী স্বেচ্ছা অন্ধত্ব বরণ করেন অর্থাৎ একটা কাপড় সারাক্ষণ চোখে বেঁধে রাখতেন আমৃত্যু। তাদের সান্ত্বনা দেন ব্যাসদেব ও বিদুর। পাণ্ডবদের ক্ষমা করে দিতে বলেন । পাণ্ডবরা ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারীর পায়ে প্রণাম করেন। ধৃতরাষ্ট্র ভীমের সঙ্গে আলিঙ্গন করতে বিশেষ আগ্রহ ব্যক্ত করায় কৃষ্ণ বুঝে যান দুর্যোধনকে যুদ্ধরীতির বাইরে উরুভঙ্গ করায় ধৃতরাষ্ট্রের মহাক্ষোভ রয়েছে। এটিও বিতর্কে প্রতিপক্ষকে অনুধাবনের ক্ষমতা। কৃষ্ণ একটি লোহার ভীম পাঠান এবং তৎক্ষণাৎ শত হাতির বল নিয়ে ধৃতরাষ্ট্র তাকে আলিঙ্গনের ছলে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ফেলেন। বেঁচে যান ভীম । কৃষ্ণ বললেন, মহাশয় ভীমকে বধ করতে যাওয়া আপনার উচিত হয়নি। কারণ এ যুদ্ধ দুর্যোধনই শুরু করেছেন, ভীমরা বারবার বাধা দিয়েছিলেন। ধৃতরাষ্ট্র স্বীকার করলেন।
গান্ধারী বললেন, ভীম কেন দুর্যোধনকে অন্যায়পূর্বক মারল? ভীম পায়ে পড়ে ক্ষমা চাইলেন । যুধিষ্ঠির তাঁর পায়ে ধরতে গেলে গান্ধারী শুধু কাপড়ের ফাঁক দিয়ে যুধিষ্ঠিরের আঙুলের নখ দেখতে পান এবং সেই নখ তৎক্ষণাৎ মরে যায় । শেষ অবধি এক তর্ক-বিতর্কের আসরের পর ক্ষমাধর্ম জয়ী হয়। যুদ্ধের শেষ দিকে দুর্যোধনও অত উপলব্ধিতে দুঃখ করে বলেছিলেন- ‘যা কহিলা সত্য হলো গান্ধারী জননী/ ধর্ম বলে অস্ত্র বল তৃণ হেন গনি।
রাজত্ব ও স্বর্গারোহণের নীতি পরীক্ষা
যুধিষ্ঠির রাজা হলেন এবং দপ্তর বণ্টন করে দিলেন সবাইকে। কিন্তু আদেশ রইল সবার প্রতি। ধৃতরাষ্ট্রের উপদেশ নিতে হবে এবং সেটিই চূড়ান্ত। ভীষ্ম রাজনীতির মহান শিক্ষা ও উপদেশ রেখে এত দিনে ইচ্ছামৃত্যু নিলেন। অশ্বমেধযজ্ঞ পাণ্ডবদের আরও প্রতিপত্তি ও স্বীকৃতি এনে দিল। একপর্যায়ে ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী, কুন্তী ও বিদুর বনে চলে গেলেন। এবার সশরীরে পঞ্চপাণ্ডব হিমালয়ে স্বর্গারোহণে যাচ্ছেন।
সবার আগে দ্রৌপদী পড়ে গেলেন মৃত্যুকোলে। কারণ পঞ্চস্বামী থাকলেও তিনি অর্জুনকে বেশি ভালোবাসতেন। যুধিষ্ঠির বাদে সবাই কোনো না কোনো অপরাধে মারা গেলেন। সহদেবের অহংকার ছিল সর্বাপেক্ষা বিদ্বান বলে। নকুল ভাবত তার অপেক্ষা সুন্দর কেউ নেই। অর্জুন অন্য বীরকে তুচ্ছ করতেন। ভীম অন্যকে কম দিয়ে নিজে অপরিমিত আহার করতেন।
শেষ পরীক্ষা যুধিষ্ঠিরের স্বর্গ থেকে রং এসে নামল হিমালয়গু।ে ইহু বললেন, যুধিষ্ঠির স্বর্গে চলো। তবে তোমার পেছনের কুকুরটি কোত্থেকে এল। স্বর্গে এর প্রবেশ নিষেধ। যুধিষ্ঠিরের উত্তর এ আমার আশ্রিত। একে ফেলে আমি স্বর্গে যেতে চাই না। আসলে কুকুর ছিলেন ধর্মদেবতা। নৈতিকতার চূড়ান্ত পরীক্ষায় যুধিষ্ঠির জয়ী হয়ে সশরীরে স্বর্গে গেলেন ।
সমাপনী
বিশাল মহাকাব্য মহাভারতও একসময় শেষ হয়ে যায়। কিন্তু শেষ হয় না এ থেকে নিঃসৃত অজস্র যুক্তিবোধ, নীতিবোধ, প্রতিজ্ঞার বল, রণকৌশল ও বুদ্ধিদীপ্ত পথে প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা ও উদ্বুদ্ধ করে জয়ী হওয়ার নিরন্তর শিক্ষা । অনেক অলৌকিকত্ব আছে মহাভারতে, আছে অবিশ্বাসযোগ্য কাহিনিরও জোগান। একজন তার্কিক এগুলো পাশ কাটিয়ে অনুধাবন করবেন নীতি, প্রতিজ্ঞা ও যুক্তির শৌর্য কিংবা প্রতিপক্ষকে অধ্যয়ন করার ক্ষমতা। তাহলেই মহাভারত বিশ্লেষণের এই প্রচেষ্টা সার্থক হবে।
