বিতার্কিকের চোখে মহাকাব্য ইলিয়াড

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়ঃ বিতার্কিকের চোখে মহাকাব্য ইলিয়াড

 

বিতার্কিকের চোখে মহাকাব্য ইলিয়াড
বিতার্কিকের চোখে মহাকাব্য ইলিয়াড

 

Table of Contents

বিতার্কিকের চোখে মহাকাব্য ইলিয়াড

মহাকবি হোমারের মহাকাব্য ইলিয়াড থেকে বিতর্কের কিছু উপাদান বেরিয়ে আসে। যুক্তি ও উদ্বুদ্ধকরণের উপাদান দুটি এই মহাকাব্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সার্থকতার মুখ দেখেছে। আমরা জানি, বিতর্ক হচ্ছে যুক্তির মাধ্যমে উদ্বুদ্ধকরণের বিদ্যা।

ইলিয়াডের ঘটনাক্রম প্রাগৈতিহাসিক, যখন ‘মাইট ইজ রাইট’-এর দর্শন মানুষকে ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করত। কিন্তু সে যুগেও যে যুক্তি ও উদ্বুদ্ধকরণের ক্ষমতা কম ছিল না, তা ইলিয়াড বিশ্লেষণ করলে বহু স্থানেই ধরা পড়ে। আজকের মতো প্রাতিষ্ঠানিক বিতর্কচর্চা না থাকলেও বিতর্কের লক্ষ্য ও উপাদানচর্চায় মানবসভ্যতা যে আদিকাল থেকেই যত্নবান ছিল, সেটাও অনুধাবন করা যায় ইলিয়াড বিশ্লেষণ থেকে।

মহাকাব্যিক যুদ্ধ ও বিতর্ক

দ্বন্দ্ব ছাড়া বিতর্কের আয়োজন করা যায় না। দ্বন্দ্ব ছাড়া আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে কোনো মহাকাব্য রচিত হয়নি। মহাকাব্যে পক্ষ ও প্রতিপক্ষের অবস্থান অনিবার্য । মহাকাব্যের বীরদের মতো বিতার্কিকেরও লক্ষ্য বিজয়। একেকজন বিতার্কিক বিতর্ক-মঞ্চে হয়ে ওঠেন কখনো দুর্যোধন, কখনো অর্জুন, কখনো একিলিস, কখনো হেক্টর, কখনো মেঘনাদ, কখনো লক্ষ্মণ।

পরাজয়ে নাহি ডরে বীর, কিন্তু জয়ে তার লক্ষ্য হবে স্থির। এই জয় অর্জনে দুর্যোধনের কূটনীতি আর অর্জুনের কূটনীতি কখনো এক নয়, পক্ষ-বিপক্ষের বিতার্কিক ও কূটনীতির প্রশ্নে বিভক্ত । দুজন মুখোমুখি বিতার্কিকের তর্ককৌশল যেমন ভিন্ন, একিলিস ও হেক্টরের রণনীতিও তেমন বিপ্রতীপ। এভাবে বিতর্ক-মঞ্চে দক্ষ বিতার্কিক যেন এক-একটি মহাকাব্যিক চরিত্র নিয়ে আবির্ভূত হন।

কীর্তি অপকীর্তির সাক্ষী ট্রয়

ইলিয়াড-এর কাহিনি অনেকেরই জানা। তবু সে কাহিনি এখানে এসেছে ঘটনা অনুক্রম ও বিশ্লেষণের খাতিরে। ইলিয়াড মহাকাব্যের লীলাক্ষেত্র ভূমধ্যসাগরের একটি দ্বীপ। ট্রয়ের একজন আদি পুরুষের নাম ট্রস, তাঁর পুত্র ইলাস, তাঁর পুত্র লাওমিডন, তাঁর ভাই পদারেস বা প্রিয়াম, তাঁর পুত্র হেক্টর ও প্যারিস বা ট্রয় যুদ্ধের দুই বীর ।

 

বিতার্কিকের চোখে মহাকাব্য ইলিয়াড
বিতার্কিকের চোখে মহাকাব্য ইলিয়াড

 

প্যারিসের জন্মেই অশুভ ইঙ্গিত

প্যারিস গর্ভে থাকাকালীন প্রিয়াম-পত্নী হেকুবা স্বপ্নে দেখলেন, তিনি এক জ্বলন্ত মশাল প্রসব করছেন। জ্যোতিষী ব্যাখ্যা করলেন, ‘এর মানে এ সন্তান থেকে ট্রয় নগরী ধ্বংস হবে। অতিদারিদ্র্য বা অতিক্ষমতা উভয়ই মানুষের মানবিক গুণাবলি ধ্বংস করে। অতিদারিদ্র্যে উত্তরবঙ্গের সখিনা তার সন্তান বিক্রি করে, আর অতি ক্ষমতার মোহে প্রিয়াম-হেকুবা তাঁদের সন্তান প্যারিসকে আইডা পর্বতের দুর্গম অঞ্চলে ফেলে আসেন, ঠিক যেমন মথুরার রাজা কংস তাঁর ভগ্নি দেবকীর গর্ভজাত সাতটি সন্তানকে হত্যা করেন। একজন বিতার্কিক ঐতিহাসিক দৃষ্টি নিয়ে ক্ষমতার মোহকে এভাবেই বিশ্লেষণ করেন ।

ইনন মানে প্রথম এবং শেষ

দুর্গম অঞ্চলে পড়ে থাকলেও প্যারিস মরে না। ‘তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে’। ভালুকের দুধ খেয়ে প্যারিস হৃষ্টপুষ্ট হয়, বেড়ে ওঠে। পার্বত্য অঞ্চলের দুষ্ট লোকদের দমন করে সে হয়ে ওঠে ‘আলেকজান্ডার’ বা ‘মানুষের সাহায্যকারী’। ইনন নামের এক পার্বত্য পরি প্যারিসের বীরত্বে মুগ্ধ হয়। ইনন প্যারিসের প্রথম প্রেম, প্রথম বিয়ে। এত কীর্তি, কুকীর্তি ও ধ্বংস ডেকে আনার পর হেলেন প্রত্যাখ্যাত স্খলিত চরিত্রের প্যারিস যত দূর শোনা যায়— জীবনের অপরাহ্ণে আবার সেই ইননকেই পর্বত অঞ্চলে খুঁজে বের করেছিলেন।

বঙ্কিমচন্দ্রের বিষবৃক্ষ-র নায়ক নগেন্দ্র কুন্দনন্দিনীর মোহ উত্তীর্ণ হওয়ার পর আবার প্রথম নায়িকার কাছেই জীবনের অর্থ খুঁজে পেয়েছিলেন। মহাবীর ওডেসিয়াস দেশে ফেরার পথে এক বছর ক্যালিপসোর প্রেমে মগ্ন থাকার পর বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁর প্রথম স্ত্রী পেনিলোপিই তাঁকে সত্যিকার অর্থে ভালোবাসে ।

ইনন কি লম্পট প্যারিসকে ক্ষমা করেছিলেন? কেউ বলেন করেছিলেন, যেমন ওডিসির পেনিলোপি ক্ষমা করেছিলেন ওডেসিয়াসকে, রামায়ণ-এর মন্দোদরী ক্ষমা করেছিলেন রাক্ষসপতি রাবণকে, কিংবা বিষবৃক্ষের মূল নায়িকা সূর্যমুখী ক্ষমা করেছিলেন নগেন্দ্রকে। প্রথম স্ত্রীদের ক্ষমা ও মহানুভবতার রাজত্বও বৃহত্তর। অভিমানও বেশি। খুবই স্বাভাবিক। এ জন্য কেউ কেউ বলেন, ইনন সাত ঘাটের পানি খাওয়া ব্যর্থ প্যারিসকে ক্ষমা করতে পারেননি।

সেদিন দাউ দাউ করে এক চিতা জ্বলেছে। অভিমানী ইনন জানতে পারেন, ওটা নাকি প্যারিসের চিতা। রাবণের চিতা জ্বলে মন্দোদরীর বুকে। কিন্তু মন্দোদরীর ভরসা ছিল বিভীষণ। ইননের কেউ ছিল না। ইননের প্রথমত প্যারিস, দ্বিতীয়ত প্যারিস, শেষ পর্যন্ত প্যারিস, অতি সাধারণ প্যারিস, ভীষণ অসম্ভব প্যারিস। তিনি আত্মাহুতি দিলেন এ যেন নিষিদ্ধ সহমরণ প্রথায় স্বেচ্ছায় অগ্নিবরণ।

মহাকাব্য নিষ্প্রভ করে রেখেছে ইননকে, কিন্তু উজ্জ্বল করে তুলেছে খলনায়িকা হেলেনকে। কোথায় ইনন, আর কোথায় হেলেন। ইননের চেয়ে বড় প্রেমিকা কি হতে পারে? শেকসপিয়ারের রোমিও জুলিয়েটও ট্র্যাজেডি। কিন্তু ইনন জুলিয়েটের চেয়ে অনেক বড় মাপের প্রেমিকা, যদিও রূপলাবণ্য ও চাকচিক্যের বাহুল্যে আমরা চিনি হেলেনকে চিনি জুলিয়েটকে চিনি না ইননকে। ইননের দুর্ভাগ্য— প্যারিসকে ভালোবেসেছিলেন।

শ্রেষ্ঠ সুন্দরী নির্বাচনে প্যারিস

ধরা যাক, মাত্র কিছুক্ষণ পরই শুরু হবে একটা চূড়ান্ত বিতর্ক ঢাকা কলেজ এবং – ভিকারুননিসা নূন কলেজের মধ্যে। বিচারক হিসেবে এইমাত্র উপস্থিত হয়েছেন মহাকাব্যের মহানায়ক প্যারিস। এ ক্ষেত্রে নিশ্চিত করে আগে থেকেই বলা যায় যে ঢাকা কলেজ হাজার ভালো বিতর্ক করলেও বিজয়ী হবে ভিকারুননিসা নূন কলেজ দল এবং শ্রেষ্ঠ বক্তা হবে সে দলেরই সবচেয়ে রূপবতী মেয়েটি, এমনকি সে যদি মাইকের সামনে তিন মিনিট থেমেও থাকে। প্যারিস এমনই বিচারক।

সম্ভবত ভালুকের দুগ্ধপান করে বড় হওয়ার কারণে তাঁর মধ্যে মনুষ্যযোগ্য বুদ্ধিবৃত্তির উন্নয়ন ঘটেনি। ভালুকের দুগ্ধ পান করে বড় না হলেও আমাদের সমাজে অনেক ‘প্যারিস জাজ’-এর দর্শন মেলে। যত দ্রুত সম্ভব তাঁদের ‘পেরিশ’ করা উচিত। সেদিন পর্বত ছায়ায় প্যারিস ভেড়া চরাচ্ছিলেন, হঠাৎ তাঁর সামনে তিনজন অপরূপা সুন্দরী এসে হাজির। তারা প্যারিসের কাছে জানতে চাইল, ‘কে সুন্দরতমা?

 

বিতার্কিকের চোখে মহাকাব্য ইলিয়াড
বিতার্কিকের চোখে মহাকাব্য ইলিয়াড

 

অপূর্ণ আমন্ত্রণ ও বিতর্কের সূত্রপাত

কোনো অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ তালিকা অপূর্ণ বা ত্রুটিপূর্ণ হলে আয়োজকদের তার খেসারত দিতে হয়। বিতর্ক উৎসব বা অনুষ্ঠানেও তার ব্যতিক্রম হয় না। দক্ষ রাজা বিশাল যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন। ত্রিভুবনে নিমন্ত্রণ করতে কাউকে বাদ রাখেননি। শুধু বাদ রাখলেন আপন কন্যা সতী এবং জামাতা শিবকে। দক্ষের যুক্তি ছিল ‘মেয়েকে আমন্ত্রণ করলে জামাতাকে আমন্ত্রণ করতে হয়। কিন্তু দক্ষের চোখে তাঁর জামাতা ছিল অপ্রকৃতিস্থ, গাজাখোর। মাঝেমধ্যেই ভূত-প্রেতসহ নৃত্যগীত করে। এ রকম পাগল জামাই যজ্ঞ অনুষ্ঠানে এলে দক্ষ রাজার সম্মান থাকে কোথায়। সতী ভীষণ কাঁদলেন। বাবার ওপর ভীষণ অভিমান হলো, দেখা করবেন না, কথা বলবেন না বাবার সঙ্গে।

পাগল হোক মাতাল হোক, তবু তো তাঁর স্বামী। বাবার উচিত হয়নি তাঁর স্বামীকে এত ছোট করা। বিয়ের পর প্রায় সব মেয়েই স্বামীকে বড় করে তোলে। প্রয়োজনে বাবার বিপক্ষে। থাকতে পারলেন না সতী ছুটে গেলেন যজ্ঞ অনুষ্ঠানে। অনেকেই তাকে অপমান করল, নিমন্ত্রণ না পেয়েও ছুটে এসেছেন নির্লজ্জের মতো। লজ্জা নেই, পাগলের বউ। দুঃখে, ক্ষোভে, অপমানে সতী দেহত্যাগ করলেন ৷ মুহূর্তেই সংবাদ চলে গেল শিবের কাছে।

পাগল হলেও শিব তাঁর স্ত্রীকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন। কারণ, পাগলেরাই স্ত্রীদের সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে । বিক্ষুব্ধ শিব সদলবলে এসে সমস্ত দক্ষযজ্ঞ লন্ডভন্ড করে দিলেন কোথায় রাজা, কোথায় সেনাপতি, কোথায় অতিথি। যার যার জীবন নিয়ে দৌড় এবার শিব সতীর নিষ্প্রাণ দেহ সৎকার করতে দিলেন না। মাথায় নিয়ে ত্রিভুবন ভ্রমণ করবেন। সতীকে জীবন থেকে আলাদা হতে দেবেন না।

দলদেবী থেটিসের বিয়েতে নিমন্ত্রণ

পেলেউস (একিলিসের পিতা) যখন বিয়ে করেন জলদেবী থেটিসকে তখনো আমন্ত্রণ তালিকা অপূর্ণ ছিল। সব দেবতাই নিমন্ত্রিত হন একমাত্র এরিস ছাড়া । এরিস শিবের মতো গিয়ে লন্ডভন্ড করলেন না, তবে কূটনীতিতে ঝগড়া লাগিয়ে দিলেন। লাবণ্যময়ী দেবীদের মধ্যে একটা সুবর্ণ আপেল ছুঁড়ে দিলেন, যার গায়ে লেখা ছিল “সর্বশ্রেষ্ঠ সুন্দরীর জন্য আপেলটিকে পাওয়ার যোগ্য কে? ঝগড়া লেগে গেল তিন দেবীর মধ্যে। দেবরাজ জিয়াস তাদের পাঠিয়ে দিলেন রাখাল যুবক প্যারিসের কাছে। এবার বিচারক প্যারিসের পর পর তিনজনের বক্তৃতা শোনার পালা।

আমার নাম হেৱা। ধন-সম্পদের দেবী, অলিম্পাসের রানি। তুমি যদি আমার পক্ষে রায় দাও, তাহলে জগতের শ্রেষ্ঠ ধন-সম্পদ হবে তোমার আমার নাম এখেন। কলাবিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী দেবী। যদি আমার পক্ষে রায় দাও, তাহলে তুমি হবে জগতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী আর কুশলী বীর ।

৩. আমার নাম আফ্রোদিতে। প্রেমের দেবী। যদি আমার পক্ষে রায় দাও, তাহলে জগতের শ্রেষ্ঠ সুন্দরীকে স্ত্রীরূপে পাবে।

প্যারিস আফ্রোদিতের হাতেই সোনার আপেলটি তুলে দিলেন। বিতর্কের রায় দিয়ে দিলেন। বাকি যে দুজন হেরে গেলেন সেই হেরা এবং এথেন, তাঁরা আসন ভাঙলেন না, হট্টগোল করলেন না, কিন্তু মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন ‘হে প্রেমান্ধ শুধু তোমাকে নয়, সমস্ত ট্রয় জাতিকে শায়েস্তা করে ছাড়ব।

 

বিতার্কিকের চোখে মহাকাব্য ইলিয়াড
বিতার্কিকের চোখে মহাকাব্য ইলিয়াড

 

প্যারিস এক অসততার নাম

পাঠক, আপনি কাকে পছন্দ করতেন? আমার মনে হয়, একটু দরিদ্র হলে হেরাকে মধ্যবিত্ত পরিবারের হলে এথেনকে এবং লক্ষ্মী সরস্বতীসম্পন্ন পরিবারের ছেলে হলে নিশ্চয় আফ্রোদিতেকে পছন্দ করতেন । কিংবা ধরা যাক, সব বাদ দিয়ে আফ্রোদিতেকেই পছন্দ করতেন, কারণ প্রেম ও রূপের আকর্ষণ দুর্বার। কিন্তু প্যারিসকে ক্ষমা করা যায় না। তাঁর ঘরে তখন ছিলেন স্ত্রী ইনন, যার চেয়ে সুন্দরী তখনো প্যারিস কাউকে দেখেননি। ইননের সঙ্গে তাঁর বিচ্ছেদও হয়নি, বিবাদও হয়নি । কিন্তু কী করে প্যারিসের ইচ্ছে হলো এর চেয়েও ভালো প্রেমিকা ভালো রূপবতী পেতে, জ্ঞানবিদ্যা, বীরত্ব, সম্পদ সব পায়ে ঠেলে দিয়ে। আসলে রতনে রতন চেনে’। একে প্রেমাকর্ষণ না বলে ভালোবাসার অগভীরতা বলাই শ্রেয়। দুর্ভাগ্য ইননের।

প্যারিসের উত্থান ও হেলেনপ্রাপ্তি

ঘটনা সৌভাগ্যের বরপুত্র প্যারিসের অনুকূলে। রাজা প্রিয়াম আয়োজিত প্রতিযোগিতায় সে প্রথম স্থান অধিকার করে। মহাকাব্যিক নায়কদের বীরত্বই বড় চরিত্র। রাজা প্রিয়ামের কন্যা ক্যাসান্ড্রা একজন ভবিষ্যদ্বক্তা। সে চিনিয়ে দেয় প্যারিসকে। স্নেহাবেগে রাজা-রানি ভুলে যান ভবিষ্যদ্বাণীর কথা। এবার রাজা প্রিয়াম প্যারিসকে পাঠান গ্রিসে। উদ্দেশ্য তাঁর বোন হেমিওনকে উদ্ধার করে আনা।

গ্রিসে পৌঁছে প্যারিস প্রথমেই আতিথ্য গ্রহণ করেন রাজা মেনেলাসের। এখানেই মেনেলাস-পত্নী হেলেনের সঙ্গে তাঁর দেখা। প্রথম দর্শনেই প্রেম, প্রণয়, প্রথম সর্বনাশের সূত্রপাত, যে সূত্রপাত লঙ্কাপতি রাবণ করেছিল সীতা দর্শনে। সীতা হরণ এবং প্যারিস কর্তৃক হেলেন হরণ একাকার হয়ে সৃষ্টি করে গেল দুটি মহাকাব্য।

এবার রাজা মেনেলাস বেরিয়ে গেলেন এক সামরিক অভিযানে পত্নী হেলেন ও কন্যা হার্মিওনকে রেখে গেলেন প্যারিসের তত্ত্বাবধানে প্যারিসের মনে পড়ে গেল আফ্রোদিতের কথা, যিনি বর দিয়েছিলেন সবচেয়ে রূপময়ীর প্রেম লাভের প্যারিস বুঝলেন, ‘এ-ই সেই। হেলেনও ছিলেন খলিতচিত্ত স্রষ্টা। ধনরত্ন, হেলেনসহ প্যারিস পালিয়ে এলেন। জাহাজের পাল তুলে দিলেন ট্রয়ের উদ্দেশে। লালসা প্যারিসের সমস্ত বিবেক ও যুক্তিকে গ্রাস করে নিল। এ জন্যই প্যারিস বিতার্কিক হতে পারেননি; পেরেছিলেন অন্যজন, নাম তাঁর ওডেসিয়াস, গ্রিক বীর এবং একই সঙ্গে মহাকাব্যিক বিতার্কিক।

প্রিয়ামের বিচারিক পক্ষপাতিত্ব

ওডেসিয়াস ছুটে এসেছিলেন রাজা প্রিয়ামের কাছে, বীরত্ব দেখাতে নয়, যুক্তি দিয়ে বোঝাতে প্যারিস অন্যায় করেছেন। যুক্তি দিয়ে এটাও বুঝিয়েছিলেন যে প্যারিস যদি তাঁর ভুল স্বীকার করেন এবং হেলেনকে ফিরিয়ে দেন, তাহলে আর বিবাদ হবে না । রাজা প্রিয়াম বিজ্ঞ ও প্রবীণ হলেও একজন পক্ষপাতদুষ্ট বিচারক। তিনি জানালেন, তাঁর বোন হেমিওন গ্রিসে স্বামী, পুত্রসহ সুখে আছে, তারপরও ওডেসিয়াসের প্রস্তাব মেনে নিলেন না, সন্ধি করলেন না গ্রিকদের সঙ্গে, ফিরিয়ে দিলেন ওডেসিয়াসকে।

প্যারিস হেলেন দেশে ফেরার পর পুত্রের অপকর্মের শাস্তি দিলেন না, ভর্ৎসনা করলেন না। শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা তাঁর ছিল, তিনি তো আর গৃহবন্দী ক্ষমতাহীন সম্রাট শাহজাহান ছিলেন না। বরং খলনায়িকা হেলেনের প্যারিসপ্রীতি দেখে গ্রিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিলেন। প্যারিসের অপকর্ম বৈধতা পেয়ে গেল একজন পক্ষপাতদুষ্ট বিচারকের ভুল সিদ্ধান্তে ।

 

বিতার্কিকের চোখে মহাকাব্য ইলিয়াড
বিতার্কিকের চোখে মহাকাব্য ইলিয়াড

 

অমানবতা দিয়ে যুদ্ধযাত্রা

যুক্তিকে অনেক সময় প্রভাবিত করে আবেগ, কিন্তু ক্ষমতার লালসা সবকিছুকেই গ্রাস করে। গ্রিকরা যুদ্ধযাত্রা করলে জাহাজগুলো সমুদ্রে স্থির হয়ে গেল। রাজজ্যোতিষী ক্যালচাস জানালেন যে রাজা অ্যাগামেমনন একবার দেবী আর্তেমিসের এক প্রিয় হরিণকে শিকারে মেরে ফেলেন। দেবী রুষ্ট হন। ফলে সমুদ্র ও বায়ুমণ্ডল স্থবির। অ্যাগামেমনন যদি তাঁর কন্যা ইফিজেনিয়াকে দেবীর উদ্দেশে বলি দিতে পারেন, তাহলেই জাহাজ চলবে।

এবার প্রতিবাদে ফেটে পড়লেন ইফিজেনিয়ার জননী রানি ক্লাইতেমেস্ত্রা, যাঁর এক চোখে পানি, অন্য চোখে আগুন ঝরতে লাগল। এবার ক্লাইতেমেস্ত্রার জননীসত্তা বড় হয়ে উঠেছিল। তাঁর পুত্র ছিল লবকুশ। কিংবা মন্দোদরীর পত্নীসত্তার চেয়ে জননীসত্তা বড় হয়ে গেল, ঠিক যেমন বনবাসে সীতার জননীসত্তা সংঘাতে নেমেছিল পত্নীসত্তার বিরুদ্ধে মেঘনাদ বধের পর নারীরা স্ত্রী হয়েই মা হয়, কিন্তু মাতৃসত্তা স্ত্রীসত্তার চেয়ে অধিক অন্তর্গত, অধিক কালজয়ী, অধিক শক্তিশালী। ক্ষমতার অন্ধ লালসায় অ্যাগামেমনন কন্যাকে বলি দিলেন। অমানবিক হত্যা দিয়ে যাত্রা শুরু হলো ট্রয়ের উদ্দেশে আরেক অমানবিক সংঘাতের উদ্দেশ্যে

আত্মভোগী বনাম আত্মাভিমানী

গ্রিকরা তখন টুয়ে পৌঁছে তাঁবু খাটিয়েছে। অ্যাগামেমনন এবং একিলিস দুজনই গ্রিক বীর, একই দলভুক্ত হলেও উপদলীয় কোন্দল বা ব্যক্তিত্বের সংঘাত ছিল, যা একই বিতর্ক দলেও থাকতে পারে। জলদেবী থেটিসের পুত্র একিলিস, যিনি বীরত্বহীন দীর্ঘ জীবন বনাম বীরত্বপূর্ণ অকালমৃত্যুর মধ্যে পরেরটি বেছে নিয়েছিলেন। এ জন্য জননী থেটিস বুঝতেন মহাযুদ্ধেই মহাবীর একিলিসির মৃত্যু হবে। তবু মায়ের মন। পুত্রের দেহকে দুর্ভেদ্য দুর্গ করে গড়ে তোলার জন্য তাকে স্টাইক্স নদীতে স্নান করান। কিন্তু গোড়ালি ঢাকা ছিল জননীর মুঠিতে।

অতএব, গোড়ালি বাদে শরীরের বাকি সব অংশ হয়ে ওঠে দুর্ভেদ্য প্যারিস ভালুকের দুধ খেলেও একিলিস খেতেন ভালুকের অস্থিমজ্জা। অস্ত্রগুরু শেইরনের কাছে দীক্ষা নিয়ে এবং সিংহের হৃৎপিণ্ড ভক্ষণ করে একিলিস হয়ে উঠেছিলেন এক সিংহসাহসী যোদ্ধা, প্যারিস তাঁর সামনে এক রূপবান শৃগাল এবং অ্যাগামেমনন এক মুকুট পরিহিত ঘোটকমাত্র।

গ্রিকরা ট্রয়ের গ্রাম থেকে বন্দী করে রমণী ক্রাইসেইসকে, যাঁকে সঙ্গে সঙ্গে অধিকারভুক্ত করে নেন অ্যাগামেমনন। ক্রাইসেইসের পিতা বৃদ্ধ পুরোহিত মেয়েকে ছেড়ে দেওয়ার জন্যে কাতর মিনতি করেন। অ্যাগামেমনন তাঁকে হটিয়ে দেন। গ্রিক শিবিরে শুরু হয় মহামারি। সবাই ক্ষুব্ধ হয়ে চাপ দেয় অ্যাগামেমননকে, ‘ক্রাইসেইসকে ছেড়ে দিন।

অ্যাগামেমননের যুক্তিহীন শর্ত ‘ছাড়তে পারি, তার বিনিময়ে একিলিসের কাছে রক্ষিতা ব্রিসেইসকে দিতে হবে আমার শিবিরে। ব্রিসেইসকে দেওয়া হলো অ্যাগামেমননের কাছে। একিলিস ভেঙে পড়লেন, বিচার দিলেন জননী থেটিসের কাছে। থেটিস বিচার দিলেন দেবরাজ জিয়াসের কাছে। ক্ষোভ ও ঘৃণায় আত্মঘাতী প্রার্থনা ছিল তাঁর গ্রিকদের সমুচিত শাস্তি দিন।

ওডেসিয়াস এক উদ্বুদ্ধকারী বিতার্কিক

বিপদে পড়লেন দেবরাজ জিয়াস। তাঁর স্ত্রী হেরা চান ট্রয়ের পতন, কিন্তু থেটিস এখন চাইছেন গ্রিকদের শাস্তি। তবে তিনি হচ্ছেন বিতর্কসভার একজন নিরাপদ বিচারক, কাউকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেন না। নিদ্রা বিভোর অ্যাগামেমননের অন্তরে পাঠিয়ে দিলেন এক নৈরাশ্যের স্বপ্ন। এবার অ্যাগামেমনন হয়ে গেলেন এক উদ্বুদ্ধকারী।

ঘুম থেকে উঠেই এমন ভাষণ দিলেন যুদ্ধের বিরুদ্ধে, যা শুনে সেনানায়কেরা সৈন্যদের শিবির ছেড়ে জাহাজে ওঠার আদেশ দিলেন। সবাই রণেভঙ্গ দিল, শুধু আপন সংকল্পে অটল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন ওডেসিয়াস ও নেস্টার। তাঁরা বিপক্ষের বক্তা। এবার ওডেসিয়াস এমন এক জ্বালাময়ী উদ্বুদ্ধকারী ভাষণ দিলেন, যা শুনে সবাই যাত্রা থামাল।

কী ছিল ওডেসিয়াসের ভাষণে? শেকসপিয়ারের “ভীরুরা বারবার মরে, বীরেরা একবার’ ইত্যাদি শব্দমালা? নিশ্চয়ই নয়। তবে তার চেয়েও উদ্বুদ্ধকারী কোনো বক্তব্য, সেনানায়ক হিসেবে কোনো বল প্রয়োগ নয়। এখানেই ওডেসিয়াস হয়ে উঠেছেন একজন সার্থক মহাকাব্যিক বিতার্কিক। লঙ্কায় রামচন্দ্র বললেন, ‘ভাই লক্ষ্মণ, যুদ্ধ করব না, তুমি দেশে ফিরে যাও। লক্ষ্মণ বললেন, “যুদ্ধ মানেই আমাদের জয়-পরাজয় নয়, এ যুদ্ধ কর্তব্যের, দুষ্টের দমন আমাদের কর্তব্য।’ রামচন্দ্র আবার যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ হলেন ।

কারবালার প্রান্তরেও যুদ্ধের প্রয়োজন ছিল না, কিন্তু অন্যায়ের প্রতিশোধে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়ল। খোদ কুরুক্ষেত্রে দাঁড়িয়েই অর্জুন বললেন, ‘যুদ্ধ করব না স্বজনের বিরুদ্ধে। শ্রীকৃষ্ণ দিলেন এক উদ্বুদ্ধকারী ভাষণ, যা গ্রন্থিত হলো শ্রীগীতায় । এবার অর্জুন আবার ধনুর্বাণ তুলে নিলেন, যুদ্ধ করতেই হবে। যুদ্ধে উদ্বুদ্ধকারী ভাষণ দানে লক্ষ্মণ, শ্রীকৃষ্ণ ও ওডেসিয়াস একাকার হয়ে যান। যোদ্ধা নন, বিতার্কিক সত্তায় ।

 

বিতার্কিকের চোখে মহাকাব্য ইলিয়াড
বিতার্কিকের চোখে মহাকাব্য ইলিয়াড

 

হেক্টর এক মহাকাব্যিক বিতার্কিক

টুয়ের পক্ষ থেকে প্রথমেই যুদ্ধে এগিয়ে এলেন প্যারিস। গ্রিক পক্ষে মেনেলাসকে দেখে তাঁর মনোবল ভেঙে গেল, কিন্তু হেলেনের হারানো ভালোবাসা উথলে উঠল রাজা মেনেলাসের জন্যে। প্যারিস পালাতে লাগলেন। ধরা খেলেন বড় ভাই হেক্টরের কাছে। হেক্টর একজন বিতার্কিকের মতো শ্লেষ করে যুক্তি দিলেন, ‘দেহটা তোমার সুন্দর হলেও মনটা তোমার হীন কাপুরুষোচিত। সামান্য এক নারীর সৌন্দর্যে মোহমুগ্ধ হয়ে যে যুদ্ধের অবতারণা করেছ, সে যুদ্ধে তুমিই পিছিয়ে যাচ্ছ কোন যুক্তিতে। ধিক তোমাকে!” সম্পন্ন হলো শ্লেষের মাধ্যমে উদ্বুদ্ধকরণ। প্যারিস আবার মুখোমুখি হলেন মেনেলাসের। হেরে গিয়ে ধরা পড়লেন মেনেলাসের হাতে। কিন্তু দেবী আফ্রোদিতে কৃত্রিম মেঘ দিয়ে তাঁকে বাঁচিয়ে এনে সঁপে দিলেন হেলেনের সেবাশয্যায়।

এরপর অনেক যুদ্ধ হলো গ্রিক আর ট্রয় পক্ষে। আবারও একদিন শ্লেষের শিকার হলেন প্যারিস, ট্রয়বাসী যখন গ্রিক বীর ডাওমিড এবং অ্যাজান্সের বীরত্ব নিয়ে উৎকণ্ঠিত। অনেকটা বিতার্কিকের বিচারকর্তৃষ্টির মতো হেক্টরমাতা রানি হেকুবা যখন যুদ্ধদেবীর মন্দিরে পুজো দিয়ে গ্রিক বীর দুজনের শক্তি প্রশমিত করতে চাইছেন, ঠিক তখন হেক্টরভ্রাতা প্যারিস হেলেন ও সহচরীদের নিয়ে রঙ্গলীলায় মত্ত।

খেপে গেলেন হেক্টর ‘তোমার জন্য অসংখ্য বীর যুদ্ধে প্রাণ বলি দিচ্ছে আর তুমি রয়েছ রমণীসঙ্গের রঙ্গলীলায় মত্ত। ধিক তোমাকে!’ প্যারিস না। হলেও হেলেন লজ্জিত হলেন। সেখান থেকে ছুটে এলেন হেক্টর-স্ত্রী অ্যান্ড্রোমেকের অশ্রু মোছাতে। অ্যান্ড্রোমেক বনাম হেলেন, ত্যাগী বনাম ভোগী । অ্যান্ড্রোমেক হেক্টরের জন্যই সৃষ্টি হয়েছিলেন, হেক্টরকে আরও বড় করতে পতিব্রতা হয়েছিলেন। কিন্তু হেলেন প্যারিসের জন্য সৃষ্টি হননি, যেমন ক্লিওপেট্টা সৃষ্টি হননি কোনো পৌরুষকে উজ্জ্বল করতে।

শত হলেও অ্যান্ড্রোমেক তখন স্ত্রী ও জননী । দ্বৈত সত্তায় তাঁর কাতর আবেদন যুদ্ধে না গিয়ে তুমি বরং নগরীর ভেতরটা রক্ষা করো প্রিয়’—যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার আগে সব বীরের সহধর্মিণীদের এই একই আকুতি। একই অনুরোধের সম্মুখীন হয়েছিলেন মেঘনাদ; কাশেমকে ধরে রাখতে চেয়েছিলেন সখিনা; রাবণকে মন্দোদরী। কিন্তু বীরেরা প্যারিস নন, তাঁরা যাবেনই। তাই হেক্টরের উত্তর ছিল ‘অ্যান্ড্রোমেক, আমি তোমাকে ভালোবাসি ঠিক, কিন্তু দেশের সম্মানকে আরও বেশি ভালোবাসি। যুদ্ধ আমাকে যেতেই হবে। কর্তব্যে প্রগাঢ়তা এবং মনোবল সম্পদে হেক্টর যেন এক মহাকাব্যিক যুক্তিবাদী।

সৌজন্য ও নিরপেক্ষতা

প্যারিস আর অ্যাজাক্সের যুদ্ধ হচ্ছে। জয়-পরাজয় নির্ণীত হওয়ার আগেই সন্ধ্যা হয়ে এল। যুদ্ধ থামিয়ে তাঁরা পরস্পরকে অভিবাদন জানিয়ে আপন আপন শিবিরে চলে গেলেন ৷ এ যেন যুদ্ধ নয়, বিতর্কসুলভ সৌজন্য। দেবরাজ জিয়াস আবার ডাকলেন বিচারসভা, দেবতাদের বললেন কোনো না কোনো পক্ষে যোগ দিতে  নিরপেক্ষতা ভন্ডামির নামান্তর। বিতর্কে বিচারক যেমন কোনো না কোনো পক্ষে অপ্রিয় হয়ে ওঠেন, দেবরাজ জিয়াসও তেমন অপ্রিয় হয়ে উঠলেন গ্রিকপক্ষে। জিয়াসের অন্তরে হেরা আর ঘেটিসের বিতর্ক চলছিল, জিয়াস রায় প্রদানে যেন থেটিসের দিকে ঝুঁকে পড়লেন ।

গ্রিকরা আবার ক্লান্ত হয়ে পড়ল। চিরায়ত স্বভাবে অ্যাগামেমনন আবার ভাষণ দিলেন যুদ্ধের নিষ্ফলতা নিয়ে। উদ্বুদ্ধও হলেন অনেকে। কিন্তু এবার বিপক্ষের দলপতি ওডেসিয়াস নন, ডাওমিড। তাঁর দলে আছেন মেনেলাস এবং বৃদ্ধ নেস্টার। বিতর্কে বিপক্ষ জয়ী হলো। সিদ্ধান্ত হলো স্বেচ্ছায় অকর্মণ্য একিলিসকে যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

ঢুকে গেলেন ট্রয়ব্যূহে

একিলিসের প্রিয়তমা বন্দিনী ব্রিসেইস, ধনরত্ন, মন ও প্রচুর উপঢৌকনসহ এক দল চলে এল একিলিসের শিবিরে। দলপতি ওডেসিয়াস। যুক্তি-তর্কসহ অনেকভাবে বক্তব্য রাখলেন ওডেসিয়াস। কিন্তু একিলিস উদ্বুদ্ধকরণ প্রকল্প ব্যর্থ হলো । বক্তা হিসেবে ওডেসিয়াস এবার হেরে গেলেন । কিন্তু এবার অন্য কূটনীতি অবলম্বন করলেন । প্রতিপক্ষের বিতর্ক পাণ্ডুলিপি জেনে যাওয়ার মতো ট্রয়পক্ষের সামরিক কৌশল জেনে নিলেন । যুদ্ধ শুরু হলো কিন্তু হেক্টরের প্রবল বিক্রমে পিছু হটলেন অ্যাগামেমনন ও ডাওমিড।

গ্রিকদের শোচনীয় পরাজয় দেখে একিলিস কিছুটা উদ্বুদ্ধ হলেন। পাঠালেন তাঁর পরম বন্ধু প্যাট্রোক্লাসকে আপন সাজে সাজিয়ে। সাবধান করে দিলেন কোনো অবস্থাতেই যেন প্যাট্রোক্লাস ট্রয় দুর্গের কাছে চলে না যান। বিজয়ের মদমত্তে প্যাট্রোক্লাস ভুলে গেলেন একিলিসের সাবধানবাণী অভিমন্যু যেন ঢুকে গেলেন কৌরবব্যূহে, প্যাট্রোক্লাস তেমনি ঢুকে গেলেন ট্রয়ব্যূহে। নিহত হলেন হেক্টরের হাতে। শোনামাত্র একিলিস সিংহনাদ করে উঠলেন-এবার তিনি যুদ্ধে যাবেন। ঘটনা মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে বেশি। একিলিস সেটাই প্রমাণ করলেন।

 

বিতার্কিকের চোখে মহাকাব্য ইলিয়াড
বিতার্কিকের চোখে মহাকাব্য ইলিয়াড

 

হেক্টর-একিলিস যুদ্ধ যেন চূড়ান্ত বিতর্ক

এবার একিলিস যুদ্ধ অবতীর্ণ হলেন। হেক্টর-একিলিস যুদ্ধ। চূড়ান্ত বিতর্কের মতো শ্বাসরুদ্ধকর । এক পক্ষে প্রচণ্ড মনোবল, অন্য পক্ষে বিজয়ের অভিজ্ঞতা। চূড়ান্ত বিতর্কের মতোই সবাই কোনো না কোনো পক্ষ নিলেন। দেবতাদের মধ্যে গ্রিকপক্ষে নামলেন হেরা, প্যালাস এখেন, পসেডন, হার্মিস আর হিফাস্টাস। ট্রিয়পক্ষে নামলেন অ্যারেস, অ্যাপোলো, আর্তেমিস ও আফ্রোদিতে। হঠাৎ হেক্টর একিলিসকে দেখে প্রচণ্ড ভয় পেলেন, আত্মরক্ষার্থে পিছু হটলেন। কিন্তু নগরীর বিশাল দ্বার তখন বন্ধ। ট্রয় নগরীর প্রাচীর তিনবার প্রদক্ষিণের পর একিলিসের তরবারিতে নিহত হলেন।

বন্ধু হত্যার জিঘাংসায় এবার একিলিস হেক্টরকে তাঁর রথের সঙ্গে বেঁধে টানতে লাগলেন। ট্রয় নগরীর প্রাচীর শীর্ষ থেকে অনেকেই দেখলেন। পরাজিত বেদনার ক্রন্দনরোল ধ্বনিত হলো ট্রয় প্রাসাদে। অ্যান্ড্রোমেক মূর্ছিত হলেন। হেক্টর পরাজিত হলেও বীরত্বের আসনে সম্মানিত। একিলিসকে তিনি শরবিদ্ধ করবেন কীভাবে? একিলিসের শরীর যে দৈবগুণে দুর্ভেদ্য। শক্তিশালী বিতর্কের বিজিত পক্ষও সম্মানিত, হেক্টরের মতো। বারো দিন পর বৃদ্ধ পিতা প্রিয়াম একিলিসের কাছে গেলেন পুত্রের মৃতদেহ প্রার্থনায় কীভাবে কী কথা বলেছিলেন রাজা প্রিয়াম আমরা হয়তো তা জানি না, কিন্তু একিলিস উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন।

একিলিসের গোড়ালি অর্থাৎ বিপক্ষের দুর্বলতম স্থান

একিলিসকে কেউ বধ করতে পারত না, যদি না অ্যাপোলো গোপনে প্যারিসকে বলে দিতেন, ‘একিলিসের গোড়ালিতে আঘাত করো, ওটাই আঘাতের অধীন। এ জন্য প্যারিসের মতো একজন অনুজ্জ্বল যোদ্ধার হাতে মহাবীর একিলিসের মৃত্যু হয়, গোড়ালিতে তিরের আঘাতে। বিতার্কিক যদি বিপক্ষের আসল বা অনতিক্রম্য দুর্বলতার স্থানটি জানতে পারেন, তাহলে কম পরিশ্রম দিয়েও দক্ষতর প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে পারেন।

ভীষ্মদেবের দুর্বলতা জেনে নিজের রথের সামনে শিখণ্ডীকে না বসালে অর্জুন কোনো দিনই মহাবীর ভীষ্মকে ঘায়েল করতে পারতেন না, তেমনি পারতেন না রামচন্দ্র রাবণ বংশকে সম্পূর্ণ পরাভূত করতে, যদি বিভীষণ রাবণের দুর্বলতাগুলো জানিয়ে না দিতেন। পারত না সিমার হজরত ইমাম হোসেন (রা.)-এর মস্তক বিচ্ছিন্ন করতে, যদি ইমাম হোসেন স্বয়ং তাঁর গলদেশের দুর্বল অংশটির কথা বলে না দিতেন। অতএব, ছলে, কৌশলে বা প্রজ্ঞায় বিপক্ষের দুর্বলতম স্থানের উদ্ঘাটনেই বিতার্কিকের সার্থকতম প্রস্তুতি এবং সেখানে আঘাত করাই বিজ্ঞোচিত দক্ষতা।

 

ট্রয়ের রক্ষণশীল কৌশল

এরপর অনেক যুদ্ধ হলো, ট্রয়ের পতন ঘটল না। রাজজ্যোতিষী ক্যালচাস জানালেন, ট্রয়ের মধ্যে আছে প্যালাস এথেনের মূর্তি। তা আনতে হবে। ভিখারির ছদ্মবেশে ওডেসিয়াস ও ডাওমিড তা নিয়ে এলেন। হেলেন তাঁদের চিনতে পারেন এবং বলেন, ‘আমি অনুতপ্ত, আমিও চাই ট্রয়ের পতন। ফিরে পেতে চাই আমার প্রিয়তম মেনেলাসকে বিতার্কিকের চোখে হেলেন আগাগোড়াই স্রষ্টাচারী এবং অস্থিরচিত্তা। আরও যুদ্ধ হলো। এবার ট্রয় গ্রহণ করল রক্ষণশীল নীতি। তোরণ বন্ধ । খোলা হবে না কোনো দিন। একদিন খাদ্যরসদ শেষ হয়ে গেলে গ্রিকরা বাধ্য হয়েই ফিরে যাবে।

কাঠের ঘোড়া ও বিতর্কের ফাঁদ কূটনীতি

বিজ্ঞ কৌশলবিদ ওডেসিয়াস বানালেন এক কাঠের ঘোড়া। ভেতরে অস্ত্রসহ বারোজন গ্রিক যোদ্ধা। বাইরে থেকে মনে হবে, নিছকই একটা চাকাওয়ালা ঘোড়া। রাতের আঁধারে গ্রিকরা সমস্ত তাঁবু গুটিয়ে সমুদ্রযাত্রা করে দূরে সরে থাকে। ট্রয়বাসীর আনন্দ আর ধরে না। কেউ কেউ বললেন-এ নিছক কাঠের ঘোড়া নয়, ছলনা । কে শোনে কার কথা। ট্রোজানরা টেনে নিয়ে গেল সেই ঘোড়া নগরীর মধ্যে। নগরদ্বার উন্মুক্ত রেখে সারা রাত আনন্দ-উল্লাস করল। উল্লাস ও মদ্যপানে ক্লান্ত হয়ে সবাই ঘুমিয়ে পড়ল। এটাই চেয়েছিল গ্রিকরা। তারা সম্মিলিতভাবে ঘুমের মধ্যে ট্রয়বাসীর ওপর আক্রমণ করল। প্রতিপক্ষকে দাঁড়ানোর সময় বা সুযোগ দিল না। প্রতিপক্ষ ফাঁদ কূটনীতির শিকার ।

ট্রয়বাসীর প্রতিরোধ ও বিতার্কিকের কাঙ্ক্ষিত আচরণ

তখন ট্রয়পক্ষের নেতৃত্বে ছিলেন বীর ইনিস। শত ব্যর্থতা বুঝেও যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। হঠাৎ চোখের সামনে হেলেনকে দেখে হত্যা করতে উদ্যত হলেন। তাঁর মনোভাব ‘এই সেই অভিশপ্তা নারী, যার জন্য এত হত্যা, এত রক্ত এবং ট্রয়ের পতন। ইনিসের মা বাধা দিলেন বলে রক্ষা। ট্রয় ধ্বংস হলো। হেলেন ক্ষমা চাইলেন মেনেলাসের কাছে। ব্যর্থ হলেন না । দুর্বলচিত্তের ওপর ছলনাময়ীর বিজয়। কোনো বিতার্কিক মেনেলাসের স্থানে থাকলে কি হেলেনকে ক্ষমা করতেন? পলাতক প্যারিসের জীবনের পরিণতি তো আমরা আগেই জেনেছি।

বিতর্কের নান্দনিক ও যুক্তিবাদী দৃষ্টিপটে এভাবেই বিশ্লেষিত হতে পারে মহাকাব্য ইলিয়াড়, যেখানে মহাকাব্যিক যুদ্ধ আর বিতর্কযুদ্ধ যেন একাকার হতে চায় দ্বান্দ্বিকতার জীবন বিকাশে।

Leave a Comment