বিতার্কিকের আত্ম সমালোচনা

আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়ঃ বিতার্কিকের আত্ম সমালোচনা

 

বিতার্কিকের আত্ম সমালোচনা
বিতার্কিকের আত্ম সমালোচনা

 

বিতার্কিকের আত্ম সমালোচনা

বিতর্ক মানে পাঁচ মিনিটের একটা বক্তৃতা। বাঙালি এটা অন্তত খুব পারে। এই পাঁচ মিনিটের বক্তৃতা নিয়ে হইচই করার কিছু দেখি না। কর্মশালা হতে পারে গানের ওপর, কবিতার ওপর, নাটকের ওপর, নাচের ওপর। বিতর্কের ওপর কর্মশালা—এ বড়ই বাহুল্য ঠেকছে। নাটকের গ্রুপ থিয়েটার তৈরি হবে, সংগীতের প্রতিষ্ঠান তৈরি হবে, তৈরি হবে বিভিন্ন ঘরানা। কিন্তু বিতর্ক নিয়ে তেমন প্রত্যাশা প্রচণ্ড উচ্চাভিলাষ বৈকি।

বিতর্কের জন্য চিরস্থায়ী ক্লাব, ফেডারেশন এসবের দরকার কী? বিতার্কিক যতক্ষণ ছাত্র থাকবেন, বিতর্ক করবেন, টিভিতেও সুযোগ পাবেন। ছাত্রত্ব শেষ হবে, বিতর্কও বিদায় নেবে। আর কী দরকার বিতর্ককে প্রাতিষ্ঠানিকতার গণ্ডির বাইরে টানাহেঁচড়া করার।

বিতার্কিক পরিচয় দেবে, ‘এককালে নামকরা তার্কিক ছিলাম, টিভিতেও চান্স পেয়েছিলাম, অনেকেই চিনত। তারপর আর কী, পাস করলাম, চাকরি-বাকরি পেলাম, ওসব ছেড়ে দিলাম।’ বিতর্ক নিয়ে অত হইচই করার কিছু নেই। সংগীত, নাট্যকলা বা চিত্রকলার মতো এটার কোনো পাঠ্যক্রমও নেই। বিতর্ক জানলে আলাদা চাকরিও পাওয়া যায় না; পাত্র-পাত্রীর অভিভাবকেরাও গলে যান না। বিতর্ক কোনো একনিষ্ঠ নীতিবোধ গড়ে তোলে না।

মিথ্যাবাদী হতে শেখায়, ন্যায়-অন্যায় বাছবিচারের অধিকার তার্কিকের নেই। অনেক সময় বিশ্বাসের বিরুদ্ধে বলতে শেখায়। বিষয়বস্তুর পক্ষে বা বিপক্ষে, অর্থাৎ যেদিকে বলতে বলা হয়. তার্কিক স্রেফ একজন ভাড়াটে উকিলের মতো সেদিকে বলার জন্য কোমর বেঁধে নেমে পড়েন।

আন্তরিকভাবে নিজে কোনো বিষয় বিশ্বাস না করলেও তার্কিক অনেককে বিপরীত ধারণায় উদ্বুদ্ধ করে ফেলেন, অনেকের সরল বিশ্বাসে আঘাত করেন। অনেক সম্পাদক ভাবেন, ‘বিতর্কের সংবাদ, এর আর কী ছাপব। তার চেয়ে অন্য মুখরোচক অনেক বিষয়ে সাংবাদিকেরা আগ্রহ পোষণ করেন। অভিভাবক অনেক সময় বলেন, ‘বাবা, তুমি বিতর্ক কমিয়ে লেখাপড়ায় মন দাও।’ টিভি কর্তৃপক্ষ ভাবে, বেচারা বা বেচারিকে সর্বভুক ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর সুযোগ দিয়েছি, এই তো বেশি।

তারপরও ওরা কেন এত রাজনৈতিক কথা বলবে, কিংবা সরকারকে সমালোচনা করবে। যদি-বা করেই—কাঁচি তো আছেই। প্রয়োজনে ‘সম্মানিত সভাপতি’ আর ‘ধন্যবাদ’ রেখে দেব বাকিটা কেটে। চেহারাটা ‘অন এয়ার’ গেলেই হলো। বিপ্লবী ভাবেন, নাটক দিয়ে আন্দোলন করা যায়, করা যায়। কবিতা বা গণসংগীত দিয়েও। কিন্তু বিতর্ক? তার ওপর আন্দোলনের ভরসা রাখা যায় না। ও নেহাতই যান্ত্রিক সীমাবদ্ধ উপস্থাপন।

বিতর্ক-সম্পর্কিত উপরিউক্ত দৃষ্টিভঙ্গি, প্রচারণা, মনোভাব এবং সর্বোপরি প্রবণতা প্রচলিত সমাজে বড়ই প্রকট। ১৯৭৬ থেকে টানা তিন দশক সবচেয়ে শক্তিশালী জাতীয় প্রচারমাধ্যম টেলিভিশনে বিতর্কের দখল যথেষ্ট বিস্তৃত ছিল। ১৯৮২ সালে স্বৈরাচারী সামরিক জান্তা ক্ষমতা দখলের পর টেলিভিশনে বিতর্কের ওপর শ্যেনদৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। অনুষ্ঠানটি দীর্ঘদিন বন্ধ থাকে। এখানেই প্রমাণিত হয়, বিতর্ক যেকোনো স্বৈরাচারের শক্তিশালী প্রতিপক্ষ। আশা করি, “বিতর্ক দিয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলন হয় না’—এ ধরনের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির জবাব এখানে মিলবে।

তার আগে আমাদের মধ্যে প্রশ্ন জাগে-বিতর্কের বিরুদ্ধে এসব দুর্বল দৃষ্টিভঙ্গি, নেতিবাচক মনোভাব, উন্নাসিক প্রচারণা কিংবা অবহেলার প্রবণতা তৈরি হলো কীভাবে? কেন এগুলোকে যথার্থভাবে খণ্ডন করা হয়নি, যেখানে বিতার্কিক মানেই খণ্ডনকারী? এককালে শক্তিশালী টেলিভিশনে যথেষ্ট স্থান দখল করার পরও বাইরে বিতর্ক কেন এত অনামী, এত বিশৃঙ্খল, এত অসংঘবদ্ধ, এত অনাদরপূর্ণ?

 

বিতার্কিকের আত্ম সমালোচনা
বিতার্কিকের আত্ম সমালোচনা

 

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তার প্রধান কারণ হতে পারে তিনটি

১. বৃহত্তর সংগঠনের অভাব:

যেকোনো শিল্পের প্রাথমিক সূতিকাগার স্বতন্ত্র ব্যক্তি। একটা পর্যায় আসে, যখন শিল্প ওই স্বতন্ত্র ব্যক্তিতে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। ব্যক্তিকে নিয়েই সেই শিল্প সামাজিক গণ্ডিতে প্রবেশ করে। ওই শিল্পের বিকাশে তখন প্রয়োজন সামাজিক সংগঠন। ব্যক্তিস্বার্থের ভূমিকা ছাড়িয়ে ওই শিল্প তখন বৃহত্তর সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে সামাজিক স্বার্থের কথা বলে । ওই শিল্পের বৃহত্তর সামাজিক অস্তিত্ব ও প্রবৃদ্ধি রক্ষার জন্য শিল্পীকে তখন সামাজিক গোষ্ঠী বা সংগঠনের মাধ্যমে একতাবদ্ধ হতে হয়, অগ্রসর হতে হয়। ডিমের মধ্যে পাখির জীবনটা এক স্বতন্ত্র জীবনী-সত্তা। পাখি নিজের রক্ষাকারী খোলসটা ফাটিয়ে একসময় বের হয়ে আসে সামাজিক জীবনে। কিছুদিন পর নিজের অস্তিত্বের উন্নতির স্বার্থে সে তার মতো পালকের পাখিদের সঙ্গে একতাবদ্ধ হয়।

এক পালকের পাখিরা একসাথে বেড়ায়’—কথাটার বাস্তবতা বাংলাদেশের বিতর্কশিল্পীদের ক্ষেত্রে দুই দশকেও কার্যকর হয়নি। এই শিল্পীরা বড়ই আত্মঘরানার মানুষ, বড়ই অসংঘবদ্ধ — অন্তত বৃহত্তর দৃষ্টিতে। এই অসংঘবদ্ধতাই বিতর্কের প্রধান দুর্বলতা। নাটকের জন্য গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন, কবিতার জন্য বাংলাদেশ আবৃত্তি ফেডারেশন, নৃত্যের জন্য নৃত্যশিল্পী সংস্থা প্রভৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সংশ্লিষ্ট শিল্পীদের জাতীয়ভাবে সংঘবদ্ধ করার লক্ষ্যে। কিন্তু বিতার্কিকদের জাতীয়ভাবে সংঘবদ্ধ করার জন্য সে রকম আয়োজন স্বাধীনতা-উত্তর দুই দশকেও হয়নি। ফলে অনেক বিতার্কিককে আমরা হারিয়ে ফেলেছি।

এ সময় বিতার্কিকেরা বিতর্ক করেছেন, কখনো উজ্জ্বল হয়েছেন ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের গণ্ডিতে—কখনো সামাজিক দায়িত্বে নয়, বৃহত্তর সংঘবদ্ধতার দীক্ষায় নয়। ব্যক্তি বিতার্কিক বিখ্যাত হয়েছেন পারফরমার হিসেবে, ‘অর্গানাইজার’ হিসেবে নয়। এ জন্যই দেশে শত সহস্র বিতার্কিক থাকার পরও তাঁরা কোনো একক দাবিতে সমন্বিত হতে পারেননি। বিতর্ককে একটা মর্যাদাসম্পন্ন শক্তিশালী শিল্পসত্তায় উদ্ভাসিত করার লক্ষ্যে সংঘবদ্ধ পদক্ষেপ নিতে পারেননি।

সে ব্যর্থতা কিংবা সে শূন্যতার তাগিদ থেকেই নব্বইয়ের দশকের শুরুতে গঠিত হয়েছে বাংলাদেশ ডিবেট ফেডারেশন’। উদ্দেশ্য, জাতীয়ভাবে বিতার্কিকদের সমন্বিত করা; বিতর্ককে শক্তিশালী শিল্পের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করা। কারণ, বিতর্ক হচ্ছে উদ্বুদ্ধকরণের শিল্প। বর্তমান সভ্যতা বলের নয়, যুক্তির; বর্তমান যুগ চাপানোর নয়, উদ্বুদ্ধকরণের। বিতর্ক শেখাচ্ছে জবাবদিহি, বিশ্লেষণ, নিরীক্ষা সর্বোপরি যাচাই ক্ষমতার দৃষ্টিভঙ্গি । গণতান্ত্রিক পরিবেশের উন্নয়নের শর্ত হচ্ছে জবাবদিহি, বিশ্লেষণ ও যাচাই-ক্ষমতা, যা বিতর্কশিল্পের মাধ্যমে সবচেয়ে দ্রুত শিক্ষালাভ করা যায় ।

 

বিতার্কিকের আত্ম সমালোচনা
বিতার্কিকের আত্ম সমালোচনা

 

২. প্রাতিষ্ঠানিক অবহেলা :

অনেক প্রতিষ্ঠানেই বিতর্কের চর্চা হচ্ছে। এ দৃষ্টিতে প্রাতিষ্ঠানিক অবহেলার অভিযোগ তোলা যায় না। তবে দৃষ্টিটা অন্যত্র। প্রতিষ্ঠানে বিতর্ককে একটা আলাদা সাহিত্যকর্ম হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। বিতর্ককে বাধ্যতামূলক বিকাশকর্ম হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো নিজেরা উপকৃত হতো। কেউ হয়তো যুক্তি দেখাবেন, বিতর্কের মতো সংগীত বা চিত্রাঙ্কন ও একটা শিল্প। বিতর্কের মতো এগুলোকেও তখন বাধ্যতামূলক করার দাবি উঠবে। তখন প্রতিষ্ঠানগুলো সংগীতশিল্পী, চিত্রশিল্পী, নাট্যশিল্পী বা বিতর্কশিল্পীতে ভরে উঠবে। শিক্ষাবিদ বা বিদ্বান আর তৈরি হবে না। এখানেই বিতর্কের ভিন্নতা, এখানেই শিল্প হিসেবে বিতর্কের স্বাতন্ত্র্য এবং অন্য শিল্পের তুলনায় সরাসরি উৎপাদনশীল।

ও উচ্চতর অবস্থানে। বিতর্ককে বাধ্যতামূলক করে পঠিত বিষয়ের ওপর বিতর্ক হতে পারে। এতে নিম্নোক্ত উপকার পাওয়া যাবে

ক) ছাত্রছাত্রীদের মুখস্থবিদ্যার প্রবণতা কমবে।

খ) ছাত্রছাত্রীদের সৃজনশীল চিন্তার বিকাশ ঘটবে

গ) শিক্ষাদানে শিক্ষকের চাপ কমবে এবং শিক্ষাদানের ত্রুটিগুলো দূর হবে।

ঘ) নানামুখী চিন্তার সমন্বয়ে পঠিত বিষয় একদিকে হবে সহজবোধ্য, অন্যদিকে সমৃদ্ধ।

ঙ) একই শ্রেণির পরীক্ষার্থীদের মধ্যে প্রাপ্ত নম্বরের দূরত্ব কমে আসবে।

চ) শিক্ষার্থীদের অভ্যন্তরীণ বৈষম্য কমে আসবে। শিক্ষার উন্নয়ন হবে সুষম ৩ ভারসাম্যপূর্ণ।

ধরা যাক, শিক্ষক পড়িয়েছেন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নদ-নদীর ভূমিকা ।’ তাঁর এই শিক্ষাদান সবাই যে সমানভাবে আয়ত্ত করতে পারবে, তা কিন্তু নয় । তখন শিক্ষক একটা উন্মুক্ত বিতর্কের ব্যবস্থা করতে পারেন, যার বিষয়বস্তুগুলো হতে পারে নিম্নরূপ

অ) নদ-নদীকে সঠিকভাবে ব্যবহার না করলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা সম্ভব নয়। অথবা

আ) বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নদ-নদীর ভূমিকা ক্রমহ্রাসমান।

 

বিতার্কিকের আত্ম সমালোচনা
বিতার্কিকের আত্ম সমালোচনা

 

এই উন্মুক্ত বিতর্কে যদি ছাত্রছাত্রীদের পাশাপাশি শিক্ষকও অংশগ্রহণ করেন, তাহলে প্রত্যেকের তথ্য বা তত্ত্ব প্রত্যেককে কমবেশি উপকৃত করবে। এমন তো কথা নেই যে, শিক্ষকই সব জানবেন। একে বলা হয় সংঘবদ্ধ অংশগ্রহণমূলক শিক্ষাগ্রহণ পদ্ধতি – পাশ্চাত্যের অক্সফোর্ড ও হার্ভার্ডের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এই সংঘবদ্ধ অংশগ্রহণমূলক শিক্ষাপদ্ধতিকে সর্বাধিক ফলপ্রদ বলে প্রমাণ করেছে। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, বিতর্ক একটা দুর্বোধ্য বা নীরস বিষয়কে কত চিত্তগ্রাহী ও ফলপ্রম করে তুলতে পারে। প্রাক-ব্রিটিশ ভারতের সমাজব্যবস্থা কোনটি- ক) ডি ডি কোসাম্বির বিশেষ ধরণের সামন্তবাদ, নাকি খ) কার্ল মার্ক্সের এশিয়াটিক উৎপাদনব্যবস্থা। শিক্ষক পড়ালেন । দেখাশোনা হলো, চেনাজানা হলো না ।

শিক্ষক আয়োজন করলেন বিতর্কের। এবার অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী ব্যাপারটাতে অংশগ্রহণ করল। ছাত্রছাত্রীরা খুঁজে পেল আগ্রহ, খুঁজে পেল আনন্দ । রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘আনন্দের মাঝে শিক্ষা পেল বলেই বিষয়টা শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে গেল। কঠিনভাবে ভাববাদ বনাম বস্তুবাদ, রাজনীতি বনাম অর্থনীতি, অবকাঠামো বনাম উপরিকাঠামো পড়ালে শিক্ষকের সিলেবাস হয়তো শেষ হয়, কিন্তু ছাত্রদের পরীক্ষাভীতি শেষ হয় না। কারণ, বিষয়গুলো দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ায় ছাত্রদের উপলব্ধির জগতে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়াতে পারে না, অগত্যা মগজের মুখস্থশক্তির ওপর উদ্বাস্তুর মতো ক্ষণকালীন আশ্রয় নিয়ে থাকে।

দিন না ছাত্র-শিক্ষকের সম্মিলিত অংশগ্রহণে বিতর্কের ওপর দায়িত্বটা ছেড়ে, ফল পাবেন সঙ্গে সঙ্গে। নিউটনের সূত্র বা গণিতের উপপাদ্য নিয়ে হয়তো বিতর্ক হবে না, কিন্তু উন্মুক্ত আলোচনা হতে পারে, সেটাও তো বিতর্কের শাখা। হয়তো যুক্তিখণ্ডন থাকবে না। কিন্তু বিতর্কের অন্যান্য সব উপাদান সেখানে সন্নিবেশিত রয়েছে ।

পঠিত বিষয়ের ওপর বিতর্ক হতে পারে, সমৃদ্ধি ও বোধের স্পষ্টতার স্বার্থে। এ জন্যই বিতর্ককে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব। কিন্তু সে অর্থে সংগীত, নাটক, চিত্রাঙ্কন, নৃত্য প্রভৃতি বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব অবান্তর, বাহুল্যজড়িত কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে হাস্যকর। এখানেই অন্যান্য শিল্পের পাশাপাশি বিতর্কের স্বাতন্ত্র্য ও উচ্চতা প্রমাণিত হয়। ভিটামিন ‘সি’- র ক্যাপসুল থেকে নয়, বরং ফলমূল থেকে শরীর যে রকম সরাসরি ভিটামিন “সি’র উপকার গ্রহণ করে নেয়, বিতর্ক থেকেও শিক্ষাপদ্ধতি ঠিক সে রকম সরাসরি উপকার গ্রহণ করে নেয়। অন্যান্য শিল্পের মাধ্যমকে হেয় করা হচ্ছে না, অন্যান্য শিল্পমাধ্যম তাদের স্ব স্ব ক্ষেত্রে কার্যকর।

গানের কাজ বিতর্ক দিয়ে হয় না, ঠিক সে রকম বিতর্কের কাজ গান দিয়ে হয় না। তবে অন্তত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে বিতর্কের নাড়ির যোগ সবচেয়ে বেশি। কারণ বিতর্ক সেখানে বিকল্প নয়, পরিপূরক। এই নাড়ির যোগ যত প্রবল হবে, শিক্ষাদান ও শিক্ষাগ্রহণ পদ্ধতি তত সমৃদ্ধ হবে, হবে চিত্তগ্রাহী ও আনন্দপ্রদ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বাধ্যতামূলক বিতর্ক কার্যক্রম চালু করে এ সিদ্ধান্তের সত্যতা প্রমাণ করতে পারে। টেলিভিশনে স্কুল বিতর্ক চালু হওয়ার পর স্কুলগুলোতে বিতর্ক নিয়ে কর্মচাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছিল এবং বিতর্ক-অনুরাগী ছাত্র-শিক্ষকদের বহুমুখী জ্ঞানার্জন প্রক্রিয়া হয়েছিল বেগবান। এতে নবম-দশম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেও সৃষ্টি হয় যুক্তিবোধ এবং বহুমুখী জ্ঞানার্জনের দৃষ্টিভঙ্গি। এটা কি বিতর্কের প্রত্যক্ষ মাঙ্গলিক অবদান নয়?

 

৩. প্রকাশনাগত দীনতাঃ

সত্যি কথা বলতে কি, বহির্বিশ্বে থাকলেও বাংলাদেশে বিতর্ক-সম্পর্কিত প্রকাশনা খুবই কম। কোনো শিল্পই তত্ত্ব চর্চার প্রকাশনাগত ভিত্তি ছাড়া উন্নত হতে পারে না। স্বাধীনতার পর নৃত্যশিল্পেও এই প্রকাশনাগত দীনতা ছিল। আজ সে দীনতা অনেকটাই কেটে গেছে। ভিন্ন ভিন্ন বিতর্ক কর্মশালা ও প্রতিযোগিতাগুলোর আয়োজকেরা যে সংকলন বের করছেন, তাতে একনিষ্ঠভাবে বিতর্ক- বিষয়ক প্রবন্ধ ছাপা হচ্ছে। এতে বিতর্কের তত্ত্ব ও নিয়মাবলি আস্তে আস্তে ঘনীভূত আকার পাচ্ছে।

সাংগঠনিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রকাশনাগত দুর্বলতাগুলো দূর করার লক্ষ্যে প্রত্যেক বিতার্কিকের পাশাপাশি বিতর্ক অনুরাগীদেরও এগিয়ে আসতে হবে। শিক্ষার মানকে উন্নততর ও আধুনিক করার মানসে যাঁরা ভাবেন বা কাজ করেন, তাঁদেরও সমর্থন আসুক বিতর্কের দিকে। মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় যে উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করছে, তাকে শক্তিশালী ও সার্থকতর করে তুলতে হলে বিতর্কের বিকল্প নেই। দেশব্যাপী যোগাযোগ স্থাপন, শিক্ষায় উদ্বুদ্ধকরণ ও মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সব প্রক্রিয়াকে জনপ্রিয়করণের সবচেয়ে শক্তিশালী দায়িত্বটিই নিতে পারে বিতর্ক।

দূর হোক বিতর্ক-সম্পর্কিত বিভ্রান্তি, অপপ্রচার ও অবহেলা; এবং সেটা সম্ভব বিতর্কের নিজস্ব শক্তির উত্থান দ্বারা। কেউ করুণা করে তা করে দেবে না, বিতর্ক তা প্রত্যাশাও করে না। বিতর্ক হতাশার বিপরীত যাত্রী। জাতীয় বা আন্তর্জাতিক শত দুর্যোগের মধ্যেও বিতর্ক মানুষকে মুক্তির পথ দেখাবে। বিতর্ক তারুণ্যের স্পন্দনবহ জ্ঞানসমৃদ্ধ পথপরিক্রমায় পরানসখা বন্ধু ।

আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার,
পরানসভা বন্ধু হে আমার।

Leave a Comment