আজকে আমরা আলোচনা করবো বিতর্ক নিয়ে বেদনা ও স্বপ্নের গল্প নিয়ে

বিতর্ক নিয়ে বেদনা ও স্বপ্নের গল্প
সিডনির পথে পথে হেঁটে ক্লান্ত হইনি। একদিন শিক্ষার টানে চলে যাই নিউইয়র্কে। সময়টা দু হাজার দশকের মাঝামাঝি। একটি বিতর্ক সংগঠন আমাকে যোগাযোগ করল বাংলাদেশ থেকে ৷ খানিকটা স্মৃতি কিংবা তার বেদনা, আবার কিছুটা অনাগত কালের অভিলাষ নিয়ে লিখি এই দুঃখবোধ ও কল্পনার গল্প ।
আমি বরাবরই নিজের স্বপ্নগুলো থেকে যোজন যোজন দূরে পড়ে থাকি। বিতার্কিকদের কাছ থেকে যে অগাধ ভালোবাসা ও প্রেরণা পেয়েছি যা কিনা একমাত্র ব্যাপার যা আমার স্বপ্নকেও ছাপিয়ে গেছে। আমি তাদের ভালোবাসা ও প্রত্যাশার প্রতিদান দিতে পারিনি। এ জন্য তখন থেকেই আমার দুঃখবোধ হতে থাকে । এভাবেই স্বপ্ন ও দুঃখের গল্পটা শুরু হয়। কোথায় থামতে হবে? আমি কখনোই জানতে পারিনি।
বিডিএফ নামের একটা বিতর্ক সংগঠনে কাজ করার সুবর্ণ সুযোগ আমি পেয়েছিলাম। সেখানে আমি কোনোক্রমে টিকে থাকতে পেরেছিলাম মূলত সেখানকার ভাইবোনদের আন্তরিক সহযোগিতার কারণে। তাদের আশা পূরণ করা আমার স্বপ্ন ছিল। আর যখন আমি তাতে ব্যর্থ হই, তখনই সেটা দুঃখে পরিণত হয় ।

সামরিক স্বৈরাচারের আমলে বিতর্কচর্চার ব্যাপারটা খুব ব্যয়বহুল ছিল। তখনকার সরকার উদ্দেশ্যমূলকভাবে টেলিভিশন বিতর্কের কণ্ঠরোধ করেছিল। কারণ, বিতর্কের সঙ্গে সব সময়ই মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রের আন্তঃসম্পর্ক থাকে। তখন বিতার্কিকেরা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার জগতে অন্যদের তুলনায় ডাইনোসরে পরিণত হলেন। তারপরও ইউরোপীয় রেনেসাঁর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ অনেক বিতার্কিককে আকৃষ্ট করল, যাঁরা আত্মকেন্দ্রিক এবং কখনোই সংগঠনে বিশ্বাসী নন।
বিডিএফ নব্বই দশকের শুরুতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এটা বিভিন্ন প্রতিকূলতা অতিক্রম করে এগোনোর অঙ্গীকার করে এবং দেশব্যাপী বিতার্কিকদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে বিতর্কের গুণমান ও স্বতঃস্ফূর্ততার উন্নয়নে কাজ শুরু করে। সেই পথচলা মোটেও সহজ ছিল না এবং কিছু মানুষ আমাদের বিহ্বলতা দেখে একধরনের বিকৃত আনন্দ পেয়েছিল। তবে অধিকাংশ দায়িত্ব আমরা সুষ্ঠুভাবেই পালন করতে পেরেছিলাম। এ জন্য দূরদর্শী শিক্ষক এবং সচেতন অভিভাবকদের ধন্যবাদ জানানো আমাদের নৈতিক দায়িত্ব ।
আমরা বিতর্কের একটি প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি তৈরি এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চৌহদ্দির বাইরে জ্ঞানচর্চার পথ সুগম করতে চেয়েছিলাম। আমাদের লক্ষ্য ছিল বিতার্কিকদের একটা সংগঠন গড়ে তোলা, যা একটি যুক্তিবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দেবে। এটাই ছিল আমাদের স্বপ্নের সর্বস্বজুড়ে। পরবর্তী সময়ে আমার যে দুঃখ, তা এ কারণেই যে আমি সেই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব একটা গ্রহণযোগ্য পর্যায় পর্যন্ত চালিয়ে যেতে পারিনি।

স্বপ্নের মধ্যে কখনো কখনো চরম ধাপে উন্নতির সম্ভাবনাও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। সেই দুঃখ এখনো আমার স্মৃতিতে জেগে আছে। তবে আমি বিশ্বাস করি সময় আমাদের অবিরাম উন্নয়নের রূপ দিতে পারে। আমার প্রবাসজীবন এখন নতুন প্রজন্মের দিকে তাকিয়ে আছে। এই তরুণেরা সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশে বিতর্কের ভবিষ্যৎ ধারা এবং দিক নির্ধারণে অবদান রাখতে পারে।
বিতর্ক আন্দোলনের অচলাবস্থা নিরসনে নতুন নেতৃত্ব দূরদর্শী কৌশল নিয়ে অগ্রসর হতে পারে। প্রশস্ত হৃদয়ের অধিকারী একজন নেতাই স্বকীয় গুণাবলি এবং পক্ষপাতশূন্য বিচারবোধ দিয়ে বিভিন্ন তিক্ত বিরোধ নিষ্পত্তি করে সংগঠনকে এগিয়ে নিতে পারবেন। সেই নেতাকে অবশ্যই আশাবাদী চেতনা, স্বপ্নদর্শী লক্ষ্য, পরিশ্রমী প্রয়াস, প্রতিভাশালী নিবেদন, সততা, ভালোবাসা এবং সর্বোপরি মানবিক মূল্যবোধে অনুপ্রাণিত হয়ে অগ্রসর হতে হবে। আমি যখন বিডিএফে কাজ করতাম, তখন আমার স্বপ্নটা এ রকমই ছিল। আমার দুঃখটাও সরল— আমি এসব সামর্থ্যের উল্লেখযোগ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছিলাম।
এতক্ষণ একজন লক্ষ্যচ্যুত পথচারীর গল্প শোনালাম, যার স্বপ্ন ও দুঃখ আছে এবং সৌভাগ্যবশত সেগুলো এখন বিস্তৃত। আর বাংলাদেশে বিতর্কের ক্ষেত্রেও নতুন জোয়ার এসেছে। সংগঠনগুলো এখন যেকোনো বড় প্রকল্প শুরু করতে পারে। যেকোনো ক্লাব বা প্রতিষ্ঠান এখন নিঃসন্দেহে আগের চেয়ে বেশি সংগঠিত এবং শক্তিশালীরূপে বিতর্ক কর্মশালা সম্পন্ন করতে পারছে। গণমাধ্যম এবং ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো বিতর্কের দিকে নাটকীয়ভাবে মনোযোগ বাড়িয়েছে। এই ‘রোম’ রাতারাতি তৈরি হয়নি। বিতার্কিক ও কর্মীদের নিবেদিতপ্রাণ প্রয়াসের ফলেই দিনে দিনে আজকের এই অর্জন সম্ভব হয়েছে।
সেই দিন আসছে যখন বিতর্ক বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় একটা পড়াশোনার বিষয় হিসেবে স্বীকৃতি পাবে। বিতর্কের কৌশল নির্ধারণকারীরা রাষ্ট্রনেতাদের পরামর্শক হবেন—এমন দিনও খুব দূরে নেই। স্বপ্নগুলো কখনোই ফুরায় না, তবে স্বপ্নের কিছু কিছু অংশ বাস্তবে রূপান্তরিত হলে দুঃখের অবসান হয় ।
