আজকে আমরা বিতর্ক ও সাংবাদিকতা সম্পর্কে আলোচনা করবো

বিতর্ক ও সাংবাদিকতা
সাংবাদিকতার সঙ্গে বিতর্কের একটা গভীর যোগাযোগ আছে। আধুনিক সাংবাদিকতার সংজ্ঞা ও উদ্দেশ্য অনেক বিস্তৃত হলেও সাদামাটা ভাষায় আমরা সাংবাদিকতার তিনটি উদ্দেশ্যের সঙ্গেই পরিচিত। এগুলো হলো ১. অবহিত করা, ২. আনন্দ দেওয়া এবং ৩. শিক্ষিত করা।
বিতর্ক উদ্বুদ্ধকরণের শিল্প। যুক্তি বিতর্কের প্রাণ, আর উপস্থাপন হচ্ছে সবচেয়ে বড় আকর্ষণ। এই উদ্বুদ্ধকরণের প্রক্রিয়াটি সবচেয়ে বেশি কার্যকর সাংবাদিকতার তৃতীয় উদ্দেশ্যের জন্য। মানুষকে শেখানোর দায়িত্ব যদি সাংবাদিকতা নিতে চায়, তাহলে তার উদ্বুদ্ধকরণের প্রক্রিয়া ভিন্ন গতি নেই। কারণ, সাংবাদিকতা গ্রামে-গঞ্জে অবস্থিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্য দিয়ে সরকারের মতো জোর করে কোনো শিক্ষা চাপিয়ে দিতে পারে না।
সাংবাদিকতার তিনটি উদ্দেশ্যের মধ্যে অপরকে শিক্ষিত করার উদ্দেশ্যটি সবচেয়ে মূল্যবান এবং বাস্তবায়ন করা সবচেয়ে কষ্টকর। সাংবাদিকতার মাধ্যমে শিক্ষিত করার অর্থ, আর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সার্কুলারের মাধ্যমে শিক্ষিত করার অর্থ এক নয়, বরং বিপরীতমুখী। রাষ্ট্রের সঙ্গে সাংবাদিকতার এখানেই সবচেয়ে বড় বিরোধ। রাষ্ট্র তার শ্রেণিস্বার্থে জনগণকে যেভাবে শিক্ষিত করতে চায়, স্তরে স্তরে সনদ দিয়ে পণ্ডিত বানাতে চায়, সাংবাদিকতা সেভাবে চায় না। বরং রাষ্ট্রীয় শিক্ষা-পদ্ধতি দায়বদ্ধ শাসকশ্রেণির কাছে, দাতাগোষ্ঠীর কাছে। শাসকগোষ্ঠীর দায়বদ্ধতা তাল বুঝে খোলস পাল্টায়, সাংবাদিকতার দায়বদ্ধতা সে তুলনায় অপরিবর্তিত, কারণ তার একটা চিরায়ত দর্শন আছে। দর্শনটি হলো বৃহত্তর জনস্বার্থের দায়বদ্ধতা ও মানবতার মাঙ্গলিক দৃষ্টিভঙ্গি ।

গণমুখী বা ফলদায়ক নয় এমন বিষয়কেও সরকার পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করতে পারে। তার বিপরীতে সাংবাদিকতা দাঁড়াতে হয়। সাংবাদিককে তখন কলম নিয়ে যুদ্ধে নামতে হয়। মানুষকে শিক্ষিত করার আগের ধাপ হচ্ছে মানুষকে জাগরিত করা, সচেতন করা। সে দায়িত্বটি হুংকার দিয়ে হয় না, হয় না আদেশ দিয়ে। তাই তো সাংবাদিকতাকে যেতে হয় উদ্বুদ্ধকরণের কঠিন প্রক্রিয়ায়। বিতর্কেরও মূলশক্তি এখানে ।
উদ্বুদ্ধকরণের কৌশলটি সবচেয়ে কার্যকর হয় স্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ায় সরকারের 1 শিক্ষাদর্শন ভালো না মন্দ, এ বিষয়টি স্থায়ীভাবে কাউকে বোঝাতে গেলে তাকে উভয় দিকের যুক্তি শোনার সুযোগ দিতে হবে। তাকে কোনো একপেশে ধারণা দিলে তা স্থায়ী হবে না। উভয় দিকের যুক্তি শোনার সুযোগ সবচেয়ে ভালো নিতে পারে বিতর্ক। এভাবে বিতর্ক এবং সুস্থ সাংবাদিকতা যেন পরিপূরক।
যে সাংবাদিকতা বিতর্কের পন্থায়, অর্থাৎ উভয় দিকের যুক্তি সন্নিবেশিত করে এবং বিরুদ্ধ মত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পরিচালিত হয়, কেবল সে সাংবাদিকতাই মানুষের মনে চেতনার জন্ম দিতে পারে এবং মানুষকে সর্বাধিক কার্যকর পন্থায় উদ্বুদ্ধ করতে পারে। ঠিক এই স্থানটিতে আচার্য জগদীশচন্দ্রের ‘কবিতা ও বিজ্ঞান’-এর মতো বিতর্ক ও সাংবাদিকতা একাকার হয়ে যায়।
বিতর্কে প্রতিপক্ষ থাকেন চোখের সামনে, সাংবাদিকতায় তাঁকে কলম দিয়ে এনে হাজির করাতে হয়। বিতর্কে কয়েকজন বিচারক থাকেন জয়-পরাজয় ঘোষণার জন্য। সাংবাদিকতায় পাঠকই বিচারক। সাংবাদিকতার যুক্তিনিষ্ঠ ও বিবেকবোধের গভীরতা যাচাই করে পাঠক রায় দেন। কখনো উদ্বুদ্ধ হয়ে রাজপথে নেমে আসেন, কখনো লেখকের বাসায় ঢিল ছোড়ার জন্য ঠিকানা খোঁজেন।
সাংবাদিকতা জাতির বিবেককে ধারণ করে। এ জন্য অনেক সময় সরকার সাংবাদিকদের অপছন্দ করে, তখন তারা সরকারের রোষের শিকার হন কয়েকজন সাংবাদিক ছাড়া অন্য অনেকেই দৈন্যদশায় কালাতিপাত করেন। কারণ একটাই। জাতির বিবেকের কথা বলতে গেলে অনেকের সঙ্গেই সন্ধি করতে পারেন না। রাজরোষ থেকে শুরু করে প্রভুরোষ সবকিছুই তাঁকে প্রতিনিয়ত দাবড়ে বেড়ায়, তবে ঘাবড়াতে পারে না। বিতর্কের দলনেতার মতো বিবেকবান সাংবাদিক প্রতিপক্ষের আক্রমণ প্রতিহত করে স্বমত প্রতিষ্ঠায় যুদ্ধ চালিয়ে যান। একাকার হয়ে যান বিতার্কিক ও সাংবাদিক।
