বিতর্কে ভালোবাসা

আজকের আলোচনার বিষয়ঃ  বিতর্কে ভালোবাসা

 

বিতর্কে ভালোবাসা
বিতর্কে ভালোবাসা

 

বিতর্কে ভালোবাসা

বিতর্ক একটি শিল্প। কিন্তু কোনো শিল্পই হৃদয়ের ভালোবাসা ছাড়া চিরঞ্জীব থাকতে পারে না। আবার কোনো শিল্পকে ভালোবেসে যদি প্রতিদানে সুখ বা আন্তরিক পুলক বা নান্দনিক আনন্দ পাওয়া না যায়, তাহলে তাকে জোর করে ভালোবাসা যায় না। রবীন্দ্রনাথের উচ্চারণে-

ভালোবেসে যদি সুখ নাহি
তবে কেন মিছে ভালোবাসা?

মোনায়েম খানের ইচ্ছেমতো ভাষাতাত্ত্বিক অধ্যাপক মুহম্মদ আবদুল হাইকে দিয়ে যে রকম রবীন্দ্রসংগীত রচনা করা যায় না, ঠিক সে রকম ইচ্ছেমতো কাউকে বিতার্কিক বানানো যায় না, তাকে যত প্রশিক্ষণই দেওয়া হোক না কেন। বিতার্কিকের সৃষ্টি হয় ।

কোনো শিল্পই কারও প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বরং পরিপূরক। তবু আমরা তাদের তুলনামূলক বিচারে অভ্যস্ত। সংগীত ও বিতর্ককে পাশাপাশি দাঁড় করালে প্রাথমিকভাবে কোনোরূপ না ভেবেচিন্তে উত্তর দিয়ে আমরা সংগীতকেই কঠিনতর শিল্প বলব, বিতর্কের চেয়ে সংগীতে হৃদয়ে অধিক আবেদন সৃষ্টি হবে, এমন কথা বলব ।

সংগীতশিক্ষায় হারমোনিয়াম অপরিহার্য, কারণ সুরকে নির্দিষ্ট স্পন্দনের মাত্রায় বা বৈজ্ঞানিক ভাষায় কম্পনসংখ্যার দৈর্ঘ্য ধরে রাখতে হয়। হারমোনিয়াম না থাকলেও বিতর্কেও এ রকম নির্দিষ্ট মাত্রা রয়েছে, যাকে অতিক্রম করলে বিতার্কিক পরিণত হন রাস্তার বক্তায়। গানে ও সুরের নির্দিষ্ট মাত্রা অতিক্রম করলে গায়ক পরিণত হন বিলাপকারীতে। হারমোনিয়ামে গান করার সময় বর্জিত গাইটে টিপ পড়লে সুরের মাধুর্য নষ্ট হয়, বিতর্ক করার সময় কোনো বর্জিত শব্দ উচ্চারিত হলেও ভাষার মাধুর্য নষ্ট হয়। সংগীত এক পরিশীলিত নিবেদন, বিতর্কও এক পরিশীলিত অর্থ, যা নিবেদিত হয় শ্রোতার হৃদয় আঙিনায় । উভয়ের লক্ষ্য চিত্ত জয়, হৃদয়কুঞ্জ বিতানে ভালো লাগার কম্পন সৃষ্টি। তাই তো সংগীতের প্রতি রবীন্দ্রনাথের আহ্বান-

জাগ জাগরে জাগ সংগীত—চিত্ত অম্বর কর তরঙ্গিত
নিবিড় নন্দিত প্রেম কম্পিত হৃদয়কুঞ্জ বিতানে।

সংগীতের প্রতি রবীন্দ্রনাথের যে আহ্বান, বিতর্কের প্রতি সে আহ্বান মোটেই বেমানান বা বাহুল্য নয়। হৃদয়কে উদ্বুদ্ধ করার মাধ্যমে তার্কিকেরা বিচারক- দর্শক-শ্রোতার হৃদয় জয় করে থাকেন।

 

বিতর্কে ভালোবাসা
বিতর্কে ভালোবাসা

 

বরং বিতর্কে জয়ের শ্রম, সংগীতে সরাসরি প্রতিপক্ষ নেই, বিতর্কে আছে। তার প্রমাণ মেলে নিচের এই ঘটনায়

একজন বক্তা মাত্র পাঁচ মিনিটের বক্তৃতায় ঝড় তুলে নেমে গেলেন তুমুল করতালির মধ্যে। এই করতালি হলো যোগাযোগ মডেলের সর্বশেষ উপাদান, যার নাম সাড়া বা ‘ফিডব্যাক’। এই সাড়া প্রমাণ করল যে দর্শক-শ্রোতা বক্তার আলোচ্য বিষয়বস্তুকে বা বিষয়বস্তুজাত মতাদর্শকে সমর্থন করেছেন। ধরুন, বিষয়বস্তুটা এ রকম ছিল ‘জাতিসংঘ বিশ্বশান্তির নিশ্চয়তা দিতে পারে না। এই বিশ্বাসটা পক্ষের বক্তা পাঁচ মিনিটে গেঁথে দিয়েছেন দর্শক-শ্রোতার অন্তরে।

এটা যথেষ্ট কঠিন কাজ, সন্দেহ নেই। কিন্তু তার চেয়েও কঠিন দায়িত্ব অপেক্ষা করছে পরবর্তী বিপক্ষ বক্তার জন্য। মাত্র এক মিনিট পর যখন তিনি মঞ্চে এলেন, তখন তিনি শুধু পাঁচ মিনিটের কথা বলতে আসেননি, তিনি আগের বক্তা কর্তৃক জনমনে প্রতিষ্ঠিত এক বিশাল বিশ্বাসের বিরুদ্ধে মোকাবিলা করতে এসেছেন। “সম্মুখে সমুদ্র তবু যেতে হবে লঙ্কা পাড়’—এমন দৃঢ়তায় বিতার্কিকদের প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হয়। রবার্ট ফ্রস্টের উচ্চারণে

The woods are lovely, dark and deep

But I have promises to keep
And miles to go before I sleep
And miles to go before I sleep.

মজার ব্যাপার এখানেই যে, দেখা গেল মাত্র তিন মিনিটের মাথাতেই পরবর্তী বক্তা প্রমাণ করলেন, ‘জাতিসংঘ বিশ্বশান্তির নিশ্চয়তা দিতে পারে। তাঁর যুক্তিসমেত তাঁকে অভিনন্দিত করলেন দর্শক-শ্রোতারা। এখানেই অনির্বচনীয় আনন্দ ও শিহরণে ভরে ওঠে বিরুদ্ধ বক্তার হৃদয়। মাত্র কিছুক্ষণ আগে প্রতিষ্ঠিত ধারণাকে অভিমন্যুর দক্ষতায় দ্রুত চুরমার করে তার্কিক অনুভব করেন বিজয়তিলক ধারণের তৃপ্ত আনন্দ।

 

মাত্র কিছুক্ষণ আগের বিরুদ্ধভাবাপন্ন সহস্র দর্শক-শ্রোতাকে মাত্র কয়েক মিনিটের মেধা, প্রজ্ঞা, তথ্য ও যুক্তির মাধ্যমে সমভাবাপন্ন সহযোদ্ধায় পরিণত করার ক্ষমতা সামান্য হতে পারে কি? এই অসামান্য সার্থকতায় নিহিত আছে বিতার্কিকের নান্দনিক সুখ অফিফিকর পুলক আর এখানেই বিতর্ককে ভালোবাসার প্রাপ্তি। বিতর্ককে ভালোবাসার প্রাপ্তিতে যদি অতটুকু সুখ না থাকত, তাহলে মিছেমিছি বিতর্কবিদ্যাকে কি বক্তা, কি শ্রোতা কেউ ভালোবাসত না।

ভালোবেসে যদি সুখ নাহি
তবে কেন মিছে ভালোবাসা।

সংগীতে ৮ মাত্রার কাহারবা তালে হঠাৎ করে ৬ মাত্রার দাদরা চলে এলে ছন্দপতন ঘটে । বিতর্কেও একটা দ্রুতি, লয় ও মাত্রা আছে। সংগীতে এই তালের লয়, মাত্রা ও দ্রুতি ধারণ করে তবলা, বিতর্কে আলাদা তবলা বাজে না। এই লয় এবং মাত্রার ধ্বনি বক্তার মধ্যে ধ্বনিত হয় বক্তব্যের যুগপৎ গতিতে। বক্তা সাবলীল গতিতে বলতে বলতে দর্শকদের অন্তরের মধ্যেও একটা লয় ও মাত্রা সৃষ্টি করেন, হঠাৎ এই লয় ও মাত্রার পতন ঘটলে ধরা পড়ে যায় বক্তার সৃজনশীলতার মন্থর বা মুখস্থ অংশ শেষ।

 

বিতর্কে ভালোবাসা
বিতর্কে ভালোবাসা

 

তখন দর্শক মুগ্ধ হন না, বরং বক্তাকে করুণা করেন এবং রসিক দর্শকেরা মাঝপথে অযথাই হাততালি দিতে থাকেন। বক্তা চালাক হলে বুঝে নেন ‘আমার দিন ফুরাল। এগুলো হচ্ছে বিতর্ককে ভালোবাসার বেদনা। ভালোবাসার সুখও আছে, বেদনাও আছে, কিন্তু এগুলো অন্তরকে স্পর্শ না করলে বিতর্ক নিয়ে কেউ আন্তরিক হতে পারবেন না। বিতর্কে যা বলতে যাচ্ছি, তাকে আগে অন্তর দিয়ে বাজিয়ে নিতে হবে। অন্যথায় আত্মবিশ্বাসের অভাব বক্তব্যে প্রতিফলিত হবে। এ জন্যই বোধ হয় বাদক অবনীন্দ্রনাথের প্রতি রবীন্দ্রনাথের উপদেশ-

ওরে অবন, অন্তর না বাজালে যন্তর বাজে না।

বিতর্ক বিতার্কিকের এক সাধনার সৃষ্টি । প্রত্যেক শিল্পীই তাঁর সাধনার সৃষ্টিকে নিজের চেয়ে বেশি ভালোবাসেন। কবি নজরুলের কণ্ঠে তার প্রমাণ মেলে-

আমায় নহে গো
ভালোবাসো শুধু ভালোবাসো মোর গান

সে ভালোবাসার সৃষ্টি যখন সমাদৃত হয়, অন্যের হৃদয় জয় করে, তখন বিতার্কিকের মনেও সূচিত হয় একজন শিল্পীর মতো আনন্দ ও সুখ। এই আনন্দ ও সুখ যে বিতার্কিককে আরও বেশি জটিল বিষয়যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার শক্তি জোগাবে, একমাত্র তিনিই চিরদিনের বস্তুনিষ্ঠ বিতার্কিক হয়ে বেঁচে থাকতে পারবেন। সুখের ক্ষণকালীন বিহ্বলতায় কিংবা কিঞ্চিৎ বিজয়ের দন্তে যে বিতার্কিক হবেন আত্মকেন্দ্রিক, তিনি অচিরেই ব্যর্থ হয়ে একদিন বিতর্কের সাফল্যকে আবিষ্কার করবেন স্মৃতির পাতায়। অহংকার ও আত্মকেন্দ্রিকতা অন্য শিল্পগুলোর চেয়ে বিতর্কে পতন আনে অনেক দ্রুত ।

এ দুটি বৈশিষ্ট্য নিয়ে আত্মিকতার খাতিরে বিতর্ককে যতই ভালোবাসা হোক না কেন, ওই নান্দনিক আনন্দ বা অনির্বচনীয় সুখ লাভ করা যাবে না। আর সুখ লাভ না করলে মিছে ভালোবেসেই-বা কী লাভ?

ভালোবেসে যদি সুখ নাহি
তবে কেন মিছে ভালোবাসা।

Leave a Comment