বিতর্কে বিদ্বেষ

আজকে আমরা বিতর্কে বিদ্বেষ সম্পর্কে আলোচনা করবো।

 

 

বিতর্কে বিদ্বেষ
বিতর্কে বিদ্বেষ

 

বিতর্কে বিদ্বেষ

বিদ্রোহী কবি নজরুল তাঁর প্রগাঢ় অনুভূতি দিয়ে বাঙালির চরিত্র অনুভব করেছিলেন। তিনি লিখেছেন-

ভিতরের দিকে যত মরিয়াছি বাহিরের দিকে তত
গুণতিতে মোরা বাড়িয়া চলেছি গরু ছাগলের মতো।

আমরা যে আত্মঘাতী তা সন্দেহাতীত এবং আত্মঘাতী হওয়ার মূল কারণ আমাদের বিদ্বেষ। বিদ্বেষ মানব অনুভূতির অনিবার্য উপাদান। কিন্তু শিক্ষা ও শিল্প দিয়ে আমরা এই বিদ্বেষকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাই, দমন করতে চাই, বশ করতে চাই। তাই সুশিক্ষিত মানুষের বিদ্বেষ কম। তিনি জানেন শিক্ষা-সমুদ্রের বালুকাবেলায় তাঁর অবস্থান। তাই বিনয়ী হয়ে ওঠেন। বিনয়ী হয়ে ওঠেন শিল্পী শিল্পের বিশালতা অনুধাবন করাই তাঁর বিনয়ী হওয়ার মূল কারণ।

নজরুল বা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বিদ্বেষ করতেন তাঁদের সমকালে এমন কবির অভাব ঘটেনি। কিন্তু ওই বিদ্বেষ তাঁদের আটকে রাখতে পারেনি। যুগে যুগে প্রত্যেক শিল্পীকে এই বিদ্বেষ সহ্য করতে হয়। কিন্তু কোনো দূরদর্শী শিল্পীই এই বিদ্বেষে নিজেকে জড়ান না, কিছুটা আহত হন বটে।

বিতর্কও একটি শিল্প। বাকশিল্প, উদ্বুদ্ধকরণের শিল্প। এই শিল্পীরা অনেক সময় একটু বেশি বিদ্বেষপরায়ণ। তার মৌলিক কারণ অবশ্য এর দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিতে বিদ্যমান। একটি মঞ্চ তৈরি হলো, এতে ৫০ জন কবি কবিতা পড়লেন বা ৩০ জন গায়ক গান পরিবেশন করলেন। প্রত্যেকেই সত্য, সুন্দর ও চেতনার ধ্রুবতারায় নিবেদন করলেন তাঁদের সাধনা। কিন্তু বিতার্কিকের ক্ষেত্রে তা ঘটল না। এখানে পক্ষ-বিপক্ষ সৃষ্টি করে দ্বন্দ্ব বাধানো হলো। বিদ্বেষ হয়ে পড়ল অনিবার্য ।

এক পক্ষ হেরে গেলে অপর পক্ষের ওপর বিদ্বেষী হয়ে ওঠেন। হাতাহাতির পর্যায়ে না গেলেও বাগবিতণ্ডা চরম আকার ধারণ করে। কোনো বিতার্কিক তাঁর বিপক্ষের কোনো বিতার্কিককে সমালোচনা করতে গেলে এমন ভাব প্রকাশ করেন, যেন বিপক্ষজন একটা মূর্খ । শ্লেষের ছলে প্রকাশিত হয় বিস্তর অবজ্ঞা।

জগতে বড় হতে হয় গুণ দিয়ে আর অমর হতে হয় মহত্ত্ব দিয়ে। পৃথিবীর তাবৎ জ্ঞানপিপাসু এবং শিল্পপ্রেমীই তাই ধাবিত হন গুণ আর মহত্ত্বের দিকে। প্রথমে গুণ তারপর মহত্ত্ব। গুণকে পাশ কাটিয়ে মহত্ত্ব দুর্বল ও নিরর্থক। অন্যদিকে মহত্ত্ববিহীন গুণ অপূর্ণ।

 

বিতর্কে বিদ্বেষ
বিতর্কে বিদ্বেষ

 

যাঁরা বিতর্কের সঙ্গে জড়িত, যাঁরা দক্ষ বিতার্কিক না হয়েও বিতর্ককর্মী, তাঁরা প্রত্যেকেই এক-একজন শিল্পপ্রেমী। ক্রমাগত গুণ অর্জন এবং গুণকে শাণিত করার কাজে তাঁরা এক-একজন তপস্বী। তাঁদের গুণ অর্জনের পরিশ্রম যদি হিমালয় পর্বত আরোহণের সঙ্গে তুলনীয় হয়, তাহলে মহত্ত্ব হচ্ছে চূড়ান্ত লক্ষ্যের শ্বেতশুভ্র চির অমলিন সেই এভারেস্ট। গুণ অর্জন একটি প্রক্রিয়া, কিন্তু লক্ষ্য হচ্ছে মহত্ত্ব।

মহত্ত্বের কোনো নির্দিষ্ট পরিমণ্ডল বা সিলেবাস নেই। তবে সহজভাবে বলা যায়, মানবিক অধিকারের প্রকাশ, মানবিক মূল্যবোধের পক্ষে কাজ প্রভৃতি মহত্ত্বের কতগুলো চিরচেনা রূপ। যে শিল্পীরা এর পক্ষে কাজ করেছেন, তাঁরা নিজেদের অজান্তেই আমাদের শ্রদ্ধার আসনে চির অমর। একজন বিতর্ক শিল্পীও এই মহত্ত্বের দিকে ধাবিত হবেন এবং তাঁর উদ্বুদ্ধকরণের গুণটিকে ব্যবহার করবেন মানবিক কল্যাণের পথে এবং মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে। একজন বিতার্কিক কিংবা বিতর্ককর্মীর জীবনে এর চেয়ে বড় ব্রত আর কী হতে পারে ।

আমি হেথায় থাকি শুধু গাইতে তোমার গান
দিয়ো তোমার জগৎ-সভায় এইটুকু মোর স্থান।

বাংলাদেশে বিতর্কের বা বিতর্কচর্চার ইতিহাস অনেক পুরোনো হতে পারে, কিন্তু সাংগঠনিক বিতর্কচর্চার ইতিহাস খুব প্রবীণ নয়। ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে বিতর্ক প্রতিযোগিতা শুরু হয়। সবচেয়ে প্রভাবশালী রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে বিতর্কের পৃষ্ঠপোষকতা বিতর্কচর্চার জন্য এক মাইলফলকের সূচনা করল। প্রাতিষ্ঠানিক বিতর্কচর্চায় একটি সাড়া জাগল। বিতর্কচর্চার স্বার্থে প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক কিছু ক্লাব গড়ে উঠল। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ ডিবেট ফেডারেশনের (বিডিএফ) জন্ম, যার উদ্দেশ্য ছিল মূলত ত্রিবিধঃ

১) বিতর্ককে পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করার প্রচেষ্টা চালানো এবং যথাসম্ভব বিতর্কের একটি পেশাগত ভিত্তি তৈরি করা।

২) বিতর্কশিল্পের বিকাশ, উত্তরণ ও জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির লক্ষ্যে পরীক্ষামূলক কাজ করা কিংবা ওই জাতীয় কাজের সহায়তা দেওয়া।

৩) বিতার্কিক ও বিতর্ককর্মীদের বৃহত্তর ঐক্য। আন্তব্যক্তিক সম্পর্ক বৃদ্ধি এবং যুক্তিবাদী সমাজ গড়ার লক্ষ্যে একটা সম্প্রদায় গড়ে তোলা।

অনেক সংগঠনেরই খুব ভালো ভালো উদ্দেশ্য থাকে। বিডিএফেরও ছিল।

কিন্তু মূল প্রশ্ন হলো, কাজ কত দূর হয়েছে। এই প্রশ্নের উত্তর অনেকে অনেক ভাবে দেবেন ৷ এই সব মতের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো একজন গণতান্ত্রিক বিতার্কিকের কর্তব্য। তা ছাড়া শুধু বিডিএফ কেন, বাংলাদেশে আরও অনেক বিতর্ক সংগঠন বিতর্কচর্চার উন্নয়নে কাজ করেছে এবং করে যাচ্ছে। যত দূর জানা যায়, বিতর্কচর্চার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সংগঠন হিসেবে নটর ডেম ডিবেটিং ক্লাব সবচেয়ে পুরোনো। এর যাত্রা শুরু হয় পঞ্চাশ দশকের প্রথম দিকে।

 

 

বিতর্কে বিদ্বেষ
বিতর্কে বিদ্বেষ

 

নব্বইয়ের দশকে বিতর্ক সংগঠন সৃষ্টির ক্ষেত্রে বেশ চাঞ্চল্য ধরা পড়ে। এ সময় অ্যাসোসিয়েশন অব ডিবেট প্রফেশনালস, হাউস অব ডিবেটরস, গ্রুপ অব ডিবেটরস, বাংলাদেশ ডিবেটিং ফেডারেশন খুলনা প্রভৃতি সংগঠন জন্মলাভ করে। এখানে কিছু সংগঠনের নাম হয়তো বাদ পড়ছে, কিন্তু এই নিবন্ধের মূল সুর তাতে ব্যাহত হবে না। সব কটি সংগঠনেরই অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে বিতার্কিক ও বিতর্ককর্মীদের মধ্যকার একতা বৃদ্ধি এবং পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে বিতর্কচর্চাকে এগিয়ে নেওয়া। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, এই লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যের জায়গাটিতে বিতার্কিক ও বিতর্ককর্মীরা ভয়ানকভাবে পিছিয়ে রয়েছেন।

নাট্যকলা, আবৃত্তি, সংগীত, নৃত্য, চিত্রকলা, চলচ্চিত্র প্রভৃতি শিল্পমাধ্যমের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট শিল্পী বা কর্মীরা যতটা ঐক্যবদ্ধ, বিতর্ক সংগঠনের ক্ষেত্রে ততটা একতা, সহমর্মিতা, পরমতসহিষ্ণুতা চোখে পড়ে না। এর কারণ কী? এ অবস্থা কি সাময়িক নাকি বিশেষ বিতর্কের ক্ষেত্রে এই দুর্বলতা স্থায়ী, তার সঠিক উত্তর পাওয়া কঠিন।

দার্শনিক হেরাক্লিটাসের যথার্থ উক্তি, ‘পরিবর্তন ব্যতীত অন্য কিছুই পৃথিবীতে স্থায়ী নয়।’ অন্তত এটি বিতর্ক অঞ্চলের প্রথম সান্ত্বনা বার্তা যে ব্যক্তিবিদ্বেষ বা আত্মঘাতী ঈর্ষা এবং পরমত অসহিষ্ণুতায় আক্রান্ত দুর্বল একতা বিতর্কের সাংগঠনিক জগতে কোনো স্থায়ী বিষয় নয়। দ্বিতীয়ত, পৃথিবীতে আশাবাদী মানুষের সংখ্যা বেশি। তা না হলে সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যেত। সেই আশাবাদে ভর করে আমরা স্বপ্ন দেখতে চাই, দুর্বল কিংবা অংশত বিদ্বেষপূর্ণ অবস্থান ভবিষ্যতে বাড়বে না, কমবে।

কীভাবে কমবে? নিশ্চয়ই তার জন্য বিতর্কসংশ্লিষ্টদের চেষ্টা করে যাওয়া উচিত। শুধু ভালোবাসা নিয়ে অন্ধভাবে কাজ করলে চলবে না। সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে প্রথম সাফল্য হচ্ছে সমস্যা চিহ্নিত করা, দ্বিতীয়ত এর গভীরে গিয়ে একেবারে মূল কারণে হাত দেওয়া। তাই বিতর্কের সাংগঠনিক অঙ্গনে বিদ্বেষ-প্রবণতার মূল কারণ কী হতে পারে, তার অন্বেষণই শান্তিপ্রিয় বিতর্কপ্রেমীদের প্রথম দায়িত্ব ।

অনেকে বলেন, বিতর্ক অঙ্গনে বিদ্বেষ, কিছু দ্বন্দ্ব থাকবেই। এটি সব অঙ্গনেই থাকে, বিতর্ক অঙ্গনে একটু বেশি থাকবে, কারণ তাদের চর্চার পদ্ধতিই দ্বান্দ্বিক। তারা বিষয়ের পক্ষে বা বিপক্ষে মোকাবিলা করে, ফলে তাদের মধ্যে মোকাবিলা, দ্বন্দ্ব বা মনস্তাত্ত্বিক সংঘাতের একটা মানসিক শক্তি এবং একটি সহজাত মনোভাব বা প্রবৃত্তি গড়ে ওঠে। এটিই বিতর্ক অঙ্গনে বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেয় অন্য যেকোনো শিল্প অঙ্গনের চেয়ে বেশি। সহজ কথায়, বিতর্কশিল্পের নিজস্ব কারণেই এর শিল্পীরা তুলনামূলকভাবে খানিকটা বেশি বিদ্বেষে জড়িয়ে পড়ে।

আপাতদৃষ্টিতে বা তাৎক্ষণিক ভাবনায় বিষয়টি সত্য মনে হলেও বিতর্কের সাংগঠনিক অঙ্গনের বিরাজমান দ্বন্দ্বকে বৈধতা দেওয়া যায় না। আসলে এই দ্বন্দ্ব স্থায়ী নয় এবং এই দ্বন্দ্ব বিতর্কশাস্ত্রের অনিবার্য ফসল নয়। শাস্ত্রশিল্পের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো যদি ওই শিল্পের কর্মীকে সরাসরিভাবে প্রভাবিত করত, তাহলে অভিনয়শিল্পে যিনি ভিলেনের অভিনয় করেন, তিনি নিজ সংসারেও ভিলেন হয়ে যেতেন। অন্যদিকে যিনি সৎ মানুষের অভিনয়ে পটু, সংসারজীবনে তিনি হয়তো মিথ্যাচারী ও বদমেজাজি। অতএব, দ্বন্দ্বের দোষ শাস্ত্রের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া শাস্ত্র বা শিল্পের প্রতি অবিচারের শামিল। মূকাভিনয়শিল্পীরা (যেমন পার্থপ্রতিম মজুমদার) নিশ্চয় ব্যক্তিজীবনে কথাবার্তা কমিয়ে আকার-ইঙ্গিতে ভাব বিনিময় করেন না।

সত্য নয় যে একজন সংগীতশিল্পী তাঁর স্বামী বা স্ত্রীর সঙ্গে সুরে সুরে কথা বলেন কিংবা নৃত্যশিল্পী নানান অঙ্গভঙ্গি ও মুদ্রার সাহায্যে সাংগঠনিক আন্দোলন করেন। অতএব, বিতর্ক একটি দ্বন্দ্বের শাস্ত্র হওয়ার কারণে বিতর্ক-সংশ্লিষ্ট মানুষ সাংগঠনিক জীবনেও দ্বন্দ্বপ্রিয় হয়ে উঠবেন—এমন যুক্তি মানা যায় না। কারণ নিশ্চয়ই অন্যত্র। সেগুলো বের করে বিতর্ক-সংশ্লিষ্ট মানুষ যদি আগেই সেগুলোর ব্যাপারে সতর্ক থাকেন কিংবা প্রয়োজনে আত্মশুদ্ধির চেষ্টা করেন, তবে বিতর্কের সাংগঠনিক অঙ্গনে অনভিপ্রেত দ্বন্দ্ব বা অপ্রিয় বিদ্বেষ দূর হবে, একই সঙ্গে সংহতি ও সম্প্রীতি হবে সুদৃঢ় ।

বিতর্কের সাংগঠনিক অঙ্গনের সাম্প্রতিক বিদ্বেষ কিংবা দ্বন্দ্বমূলক মনোভাবের প্রধান কারণ অনিয়ন্ত্রিত অহংবোধ। সামাজিক সংগঠন করতে চাইলে কমবেশি সামাজিক অহংয়ের উদ্ভব ঘটবেই। কিন্তু একজন বিতার্কিক যখন নিজের ভিত্তি, যোগ্যতা বা তুলনামূলক অবস্থা সম্বন্ধে ন্যূনতম ধারণা হারিয়ে ফেলেন তখন তার এই সামাজিক অহং অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে এবং অন্যের সঙ্গে হিসাব-নিকাশ না করেই তিনি অবিমৃষ্যকারীর মতো বিদ্বেষ বা দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। সমাজ মনোবিজ্ঞানী বন্ধনেইন অহংকে সামাজিক মিথষ্ক্রিয়ার ফলস্বরূপ বলেছেন।

সমাজ মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, অহং জন্মগত নয়। জন্মের সময় শিশু অহংবোধহীন এক জৈবিক সত্তা নিয়েই জন্মগ্রহণ করে। জন্মমুহূর্ত থেকেই যদি শিশুকে সামাজিক পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়, তাহলে দেহের দিক থেকে কালক্রমে সে পরিপক্বতা লাভ করলেও তার মধ্যে অহংবোধের উদ্ভব হবে না। নেকড়ে পালিত মানবকন্যার অহংবোধ স্বাভাবিকভাবে পালিত কন্যার অহংবোধ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। অর্থাৎ অহংবোধ মানুষের সহজাত নয়। সহজ নয় বলে এর সংশোধন, অভিযোজন ও উন্নয়ন সম্ভব।

বিতর্ক অঙ্গনে বিরাজিত অনিয়ন্ত্রিত এবং অনেক ক্ষেত্রে অপরিমেয় কিছু অহংবোধ এই অঙ্গনকে বিমর্ষ করছে। বসন্ত সম্ভাবনার আকাশে শ্রাবণের কালো মেঘ স্থান দখল করছে। হেমন্তের সকালে মাঝে মাঝে লেগেছে কালবৈশাখীর ছোবল। সাংগঠনিক ক্ষমতা, পদমোহ কিংবা অতি আত্মপ্রচারের আকাঙ্ক্ষা আসলে এই অনিয়ন্ত্রিত অহংবোধেরই উপজাত বিষয়। সেটিই বহুলাংশে ব্যাহত করছে বিতর্ক অঙ্গনে আন্তব্যক্তিক সম্পর্কের উন্নয়ন। অনেক ক্ষেত্রে স্বাভাবিক সম্পর্কের পরিবেশ বিদুষণও ঘটছে।

তাহলে এর সমাধান কী? অহংবোধ একেবারে বর্জন? এটি সম্ভব নয়, কাঙ্ক্ষিতও নয়। আসলে পরিশীলিত অহংবোধ একজন ব্যক্তিকে ওপরে উঠতে সাহায্য করে। বিনয় মানুষকে মহত্ত্ব দেয়। কিন্তু মহত্ত্বের আগে দরকার গুণ, যা অর্জনে পরিশীলিত অহংবোধ সাহায্য করে। অতএব, পরিশীলিত অহংবোধ বর্জিত মহত্ত্ব অনেকটা লবণবর্জিত ব্যঞ্জনের সমতুল্য।

এবারের প্রশ্ন হলো, কীভাবে বোঝা যাবে আমার অহংবোধ পরিশীলিত বা পরিমিত কিংবা অনিয়ন্ত্রিত নয়। এর জন্য অবশ্যই প্রয়োজন নিজেকে জানা, নিজেকে বিশ্লেষণ করা এবং নিজের অবস্থাকে সামাজিক সহস্র অবস্থাগুলোর সঙ্গে একটা তুলনায় আনা। সহজ কথায়, পরিমিত অহংবোধ অর্জনের প্রয়োজনীয় শর্ত হচ্ছে নিজেকে বোঝা এবং পর্যাপ্ত শর্ত হচ্ছে নিজের অবস্থা নিয়ে একটা তুলনামূলক বিশ্লেষণে উপনীত হওয়া। সাংগঠনিক সংহতি ও সম্প্রীতি কীভাবে গঠিত হয়, তা নিচের বিকাশপথের সাহায্যে দেখা যায়ঃ

 

বিতর্কে বিদ্বেষ
বিতর্কে বিদ্বেষ

 

নিজেকে বোঝার কথাটি নতুন নয়। নিজেকে মূল্যায়ন করতে না পারলে সামাজিক অনেক সমস্যার সৃষ্টি হয়। দার্শনিক সক্রেটিসও এটি অনুধাবন করে বলেছিলেন, নিজেকে জানো। তিনি আরও সাবধান করে বলেছেন, আত্ম-অজ্ঞতা সব মন্দ কর্মের উৎস। এটি কোনো শিল্পসংগঠনে শুধু নয়। খোদ রাষ্ট্রসংগঠনেও সত্য। ক্ষমতা দখল, সিংহাসনের মোহ এবং জোর করে আত্মপ্রশংসা আদায়ে অনেক দুঃশাসক বা সম্রাট ইতিহাসে দীর্ঘ মেয়াদে নিন্দিত হয়ে রয়েছেন।

ফরাসি রাজা ষোড়শ লুই নিজেকে বুঝতে পারেননি কিংবা সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে নিজের অবস্থার তুলনামূলক বিশ্লেষণ করেননি বলে বিশ্বখ্যাত ফরাসি বিপ্লবের আগের রাতেও কিছুই টের পাননি। শুধু ডায়েরিতে লিখেছিলেন ১৪ই জুলাই, কিছুই না। অথচ ১৯৮৯ সালের ১৪ জুলাই ঘটে গেল বাস্তিল দুর্গের পতন: ফরাসি বিপ্লবের শুভ উদ্বোধন ।

বিতর্কের সাংগঠনিক অঙ্গনেও এমনকি একটি ব্যক্তিজীবনেও এরূপ বাস্তিল দুর্গের পতন ঘটে যেতে পারে যদি অহংবোধ তার সীমানা ছাড়ায় এবং ব্যক্তি অতি উচ্চাভিলাষী হয়ে ওঠে। রবার্ট ব্রাউনিংয়ের ‘দ্য প্যাট্রিয়ট’ একদা পুষ্পপূর্ণ রাস্তায় হেঁটেই সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন। কিন্তু এরপর হয়ে পড়েন জনবিচ্ছিন্ন ৷ অর্থাৎ তুলনামূলক বিশ্লেষণ ও আত্মমূল্যায়নে তিনি ব্যর্থ হন ৷ ফলে তাঁর সামাজিক অহংবোধ সীমানা ছাড়িয়ে যায়। পরিণামে সেই একই পথে তাঁকে বিদায় নিতে হয়। পুষ্পের স্থান দখল করে অজস্র প্রস্তরখণ্ড ।

আব্রাহাম লিংকনের যথার্থ উচ্চারণ, সব মানুষকে সব সময়ের জন্য বোকা বানানো যায় না। তাই যেকোনো শিল্পী বা নেতৃত্বের মূল চেষ্টা হবে পরিমিত অহংবোধে চালিত হয়ে নিজেকে গুণসমৃদ্ধ করা এবং তাকে মহত্ত্বের দিকে ধাবিত করা। রবীন্দ্রনাথ তাই তাঁর ‘প্রশ্ন’ কবিতায় গুণসম্পন্ন ও মহত্ত্বে উজ্জীবিত মঙ্গলের দূত সম্বন্ধে বলেছেন

ভগবান, তুমি যুগে যুগে দূত পাঠায়েছ বারে বারে
দয়াহীন সংসারে-
তারা বলে গেল ‘ক্ষমা করো সবে বলে গেল ভালোবাসো-
অন্তর হতে বিদ্বেষবিষ নাশো।

অনিয়ন্ত্রিত অহংবোধকে তাড়াতে পারলেই অন্তরের বিদ্বেষবিষের বিনাশ সম্ভব। এত কিছুর পরও মানুষ আশাবাদী। একজন বিতর্কশিল্পী মনে করে, ‘দুঃখের তিমিরে যদি জ্বলে তব মঙ্গল আলোক, তবে তাই হোক তবে তাই হোক । বিতর্ক অঙ্গন পরমতসহিষ্ণুতা, বিনয়, পরমতশ্রদ্ধা, আত্মমূল্যায়ন, গুণের আকর্ষণ আর মহত্ত্বের অমোঘ অন্বেষায় ভরে উঠুক-এ প্রত্যাশা সব বিতর্কপ্রেমীর। এখানে দ্বন্দ্বের চর্চা একটি মাধ্যম মাত্র, কিন্তু লক্ষ্য সৃষ্টি, বিকাশ ও মিলন। মিলনই চূড়ান্ত সত্য।

Leave a Comment