আজকের আলোচনার বিষয়ঃ বিতর্কে উৎকর্ষ অর্জন

বিতর্কে উৎকর্ষ অর্জন
বিতর্কে উৎকর্ষ অর্জন কার না লক্ষ্য। তার খুঁটিনাটি দিকগুলো আমরা উপেক্ষা করি । এখানে তারই আলোচনা। এ লেখার উদ্দেশ্য কিছু পরামর্শমূলক। আর এই উপদেশমালার উৎস অভিজ্ঞতা ও যৌক্তিক প্রত্যাশা। পরামর্শের তো শেষ নেই। কিন্তু এ লেখায় আলোচিত বিষয়গুলো সাধারণত তার্কিকদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে বলেই এই লেখা আবশ্যক মনে হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে তার্কিকেরা ভাবেন, তিনি ঠিক কাজটি করছেন। কিন্তু যৌক্তিক প্রত্যাশা তা বলে না। এবার আমরা বিতর্কের ভাষা, কণ্ঠ, ভঙ্গি, শ্লেষ, উদ্ধৃতি, তথ্য ও শব্দগতি জাতীয় সূক্ষ্ম বিষয়গুলো নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করছি।
বিতর্কে ভাষার স্তর
যদি বিতর্কটা হয় মজার জন্য ও স্থানীয় ভাষাগুলোর সঙ্গে মানুষকে পরিচিত করার লক্ষ্যে, শুধুই আঞ্চলিক ভাষায়, তাহলে তো কথাই নেই। তখন যত খাঁটিভাবে ভাষণ আঞ্চলিক হবে তত জমবে বিতর্ক। অন্য সব ধরনের বিতর্কে শুদ্ধ বাংলার ব্যবহার আবশ্যকীয়। তবে তা বঙ্কিমীয় হবে না। তা হবে বোধগম্যতার মার্জিত রূপ। অনেকে শুদ্ধ ভাষার সঙ্গে মাঝেমধ্যে হালকা টিভি সিরিয়াল বা বাংলা নাটকের ভাষা ব্যবহার করে ফেলেন, যা মানের ছন্দপতন ঘটায়।

বিতর্কে ভাষার মাধ্যম
মাতৃভাষা হিসেবে বাংলায় বিতর্কচর্চা সর্বত্র। তবে ইংরেজিতে বিতর্কচর্চা সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষত আজকের এই বিশ্বায়নের যুগে।
বাংলায় বিতর্ক করা শিক্ষার্থীরা অনেক সময় ভাবেন ইংরেজি মাধ্যমে বিতর্ক করলে তার দক্ষতা কমে যাবে। সেটা ভুল। ইংরেজি বিতর্কে প্রচুর মনোযোগ দেওয়া উচিত। একজন তার্কিক ইংরেজিতে দক্ষ হলে বাংলাতেও তাঁর প্রকাশক্ষমতা ও প্রতিশব্দ চিন্তা করার বৃদ্ধি বাড়বে। বিতার্কিকের লক্ষ্য যদি হয় সমাজের নেতৃত্ব ও চিন্তার উত্তরণ, তাহলে তাকে বাংলা-ইংরেজি দুটোতেই সব্যসাচী হয়ে উঠতে হবে । কেউ ইচ্ছা করলে ইংরেজি দ্বন্দ্বসূত্রের বিষয়গুলো তার শিক্ষালয় বা ক্লাবে চর্চার জন্য ব্যবহার করে দেখতে পারেন। চর্চা ভিন্ন ইংরেজিতে উন্নতির আর কোনো উপায় নেই।
বিতর্কে কণ্ঠ ও স্বর আন্দোলন
কেউ ভাববেন বিতর্ক মানে সংগীত নয়। এখানে কণ্ঠের কথা আসছে কেন। বিতর্কও যে যুক্তিকথার সংগীত অন্তরের উপলব্ধি থেকে তা বোঝা যায়। সংগীতে যেমন উদারা বা ভারী নিম্নস্বর, মুদারা বা মধ্যম স্বর এবং তারা বা উচ্চস্বর আছে—সেটির যথার্থ প্রয়োগ বিতর্ককে উৎকর্য দেয়। যখন বক্তা বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ থেকে এক লাইন উদ্ধৃতি দিচ্ছেন তখন তা ওই স্বরপর্যায় বজায় রাখবে যা মূলত উচ্চস্বরীয় মার্টিন লুথার কিংয়ের ‘আই হ্যাভ আ ড্রিম’ বলার সময় কিংয়ের মতো করেই বলতে হবে। আবার রবীন্দ্রনাথের আকাশভরা সূর্যতারা’, ‘অন্তরে জাগিছ’, ‘মেঘের পরে মেঘ জমেছে’, ‘চরণ ধরিতে দিয়ো গো আমারে’ প্রভৃতি কথামালা উচ্চারণের সময় কণ্ঠকে গভীরতা দিতে হবে, ঠিক যেমনটি কবি দিয়েছিলেন। কারণ কণ্ঠের গভীরতা বা উচ্চস্বরতার সঙ্গে ভাবের সম্পর্ক আছে।
উদ্ধৃতির কথা ছাড়াও বক্তব্যের ভাব বুঝে কণ্ঠ নিয়ন্ত্রণ বিতর্ককে নতুন উৎকর্ষ প্রদান করে । বেদনামূলক কঠিন কথায় কণ্ঠে গভীরতা আনা আবশ্যক। প্রতিবাদের কথায় কণ্ঠের উচ্চস্বর বাঞ্ছনীয়। সাধারণ বক্তব্যে উচ্চস্বর ভাববিচ্যুতি ঘটায়। আবার তীব্র প্রতিরোধের কথায় উচ্চস্বর না দিলে ভাবদুর্বলতা ফুটে উঠতে পারে।
. ভাবকে পুঞ্জীভূত করে একটা উচ্চমাত্রায় নিয়ে যাওয়া রবিশংকর বা ইয়ানির সংগীতে একটা ক্রম-উত্থান অনুসরণ করে। বিতর্কে কণ্ঠের সঠিক ব্যবহারে তা করা সম্ভব, যা শ্রোতার মধ্যে অনুভূতির তীব্র প্রকাশ ঘটায়। দর্শক ফেটে পড়ে করতালিতে । হয়তো খুব বেশি কিছু আমরা ভাবিনি বিতর্কের কণ্ঠ নিয়ে । কী জানি, হয়তো এটি সংগীত নয় বলে। কিন্তু রাতের সব তারাই থাকে দিনের আলোর গভীরে—একইভাবে কণ্ঠসংগীতের একটা প্রচ্ছন্ন অনুসরণ থাকে সার্থক বিতর্কে ।
বিতর্কে শব্দগতি ও শব্দমাত্রা
বিতর্কে কণ্ঠ নিয়ে যা বলা হয়েছে সে ভাবকে মনে রেখেই শব্দগতি নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। এখানে শব্দগতি মানে কথা প্রকাশের নয়। যদি বক্তা বাক্য নিঃসরণে এ রকম একটা গতি বজায় রাখেন তাহলে তর্ক হয় বিরক্তিকর। যখন এক রকম ভাবকে পুঞ্জীভূত করা হয় তখন শব্দগতি বাড়িয়ে অনেক কথা সংকুলান করা উচিত। কিন্তু গভীরতার কথা মৃদু শব্দগতিতে মুক্ত করা উচিত। ভুপেন হাজারিকার “শীতের শিশির ভেজা রাতে’ গান শুরু হয় ধীর শব্দগতিতে। কিন্তু শব্দ সংকুলান বেড়ে যায় যখন তিনি গান ‘বস্ত্রবিহীন কোনো ক্ষেতমজুরের ভেঙে পড়া কুটিরের ধিকিধিকি জ্বলে থাকা তুষে ঢাকা আগুনের রক্তিম যেন এক উত্তাপ হই… । আবার শব্দগতি শিথিল হয় যখন শিল্পী ফিরে আসেন গানের মুখে—”শিশিরে ভেজানো রাতে ।
শব্দমাত্রা হচ্ছে কী মাত্রার বা কতটুকু প্রখরতার শব্দ বক্তা দর্শকের কানে দিতে চান । উচ্চকণ্ঠের সঙ্গে শব্দমাত্রাও বেড়ে যায়। যেমন ‘বিস্তীর্ণ দুপারে’ গান শুরু হয় মৃদু শব্দ লয় মাত্রা, সহনীয় শব্দপ্রখরতা ও কম কণ্ঠচাপ নিয়ে । কিন্তু শেষ যখন হয় অর্থাৎ ‘ও গঙ্গা তুমি ও গঙ্গা বইছ কেন?’—এই কলিতে উচ্চ শব্দমাত্রা ও তীব্র কণ্ঠস্বর এক মোহনায় মিলে যায়। সহজ কথায় কণ্ঠ, গতি ও মাত্রা এখানে স্বরপর্যায় বা ‘পিচ’, দ্রুতি বা ‘স্পিড’ এবং শব্দ শক্তি বা ‘ভলিউম’ বোঝানো যায় । বিতর্কের সঙ্গে এগুলো মিশে থাকে ঠিক দিনের আলোর গভীরে যেমন ডুবে থাকে রাতের তারকাপুঞ্জ
বিতর্কের ভঙ্গি ও দৃষ্টি
বিতর্ক নিবেদনের উৎকর্ষ দেহভঙ্গির যথার্থ প্রকাশের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। দৃঢ় কথা সোজা হয়ে বলা উচিত। ভঙ্গির সঙ্গে দেহের ভাষা (বডি ল্যাংগুয়েজ) প্রকাশিত হয়। অতএব বক্তব্য প্রকাশে আত্মবিশ্বাস প্রতিফলিত করতে হলে দাঁড়ানোর শৈলীতে তা থাকতে হবে। কোনো আক্রমণাত্মক ভাবভঙ্গি বা দৃষ্টিপাত থাকা অবাঞ্ছনীয়। বিদ্যা যদি বিনয়ের প্রকাশ ঘটায় দেহভঙ্গি ও চোখের মধ্যে তা ফুটে ওঠা উচিত। কিন্তু তা দুর্বলতা নয়। দৃঢ়তা ও বিনীত ভাবের সমন্বয়। মুক্তিবাণে বিপক্ষকে জর্জরিত করা সৌজন্যের লক্ষণ নয়। দর্শকের দিকে তাকিয়েই বিপক্ষকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো শ্রেয়তর শৈলী।
বিতর্ক সম্বোধন
দীর্ঘ বিশ বছরে সংসদীয় বিতর্কের ব্যাপক প্রসার এবং এই প্রসারের আধিকা সনাতনী ধারাকে বড় নদীগুলোর মতো প্রায় শুকিয়ে ফেলেছে। বক্তারা সম্বোধন করছেন প্রায় পঞ্চাশবার মাননীয় স্পিকার’ শুনতে শুনতে দর্শক আজ ক্লান্ত। এটি সম্মানের আধিক্য নয়, এটি মুদ্রাদোষ এবং বাচালতার অনুষঙ্গ। এটি কথার ভর। এই ভর বাড়াতে গেলে বিতর্কের ভার হারিয়ে যায়। তিনবারের বেশি স্পিকার, সভাপতি বা পরিচালককে সম্বোধন করার প্রয়োজন পড়ে না। হুজুরকে বেশি সম্বোধন করা দুর্বলতার লক্ষণ।

বিতর্কে শ্লেষ
হাততালি বিতর্কমানের সর্বোচ্চ নির্দেশক নয়। বিপক্ষকে নিয়ে ব্যঙ্গ, বিষপ বা শ্লেষ করার ক্ষমতা সবার থাকে না। কেউ তা প্রয়োগ করলে প্রচুর হাততালি পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু বিচারককে তা বিপরীত পথে প্রভাবিত করতে পারে। অর্থাৎ নম্বর কমবে বৈ বাড়বে না। সাহিত্যে প্রকাশিত কোনো শ্লেষ পরিমিতভাবে ব্যবহার করা যায়। কিন্তু তার বাহুল্য আরও বেশি ক্ষতি করতে পারে। যুক্তি শ্লেষের চেয়ে অধিকতর শক্তিশালী।
বিতর্কে উদ্ধৃতি ও প্রবাদ
যথার্থ স্থানে একটা ছোট্ট উদ্ধৃতি ভাবকে বেগবান করে এবং বক্তার পক্ষে সমর্থন বাড়ায়। তবে উদ্ধৃতির অভিধান থেকে মনীষীদের বাক্যাবলির আধিক্য বক্তাকে শক্তি তো দেয়ই না—বরং তাকে প্রেরণ করে শরণার্থী শিবিরে । খুব জানা উদ্ধৃতি এড়িয়ে চলা উচিত। তবে উদ্ধৃতির চেয়ে প্রবাদ শক্তিশালী, যথাস্থানে যার ব্যবহার উদ্বুদ্ধকরণের যোগ্য হাতিয়ার। যেহেতু সময় সীমিত, সেহেতু এগুলোর স্থান কমিয়ে নিষ্ঠার সঙ্গে আত্মযুক্তিতে তার্কিকের বিশ্বাসী হওয়া উচিত।
বিতর্কে তথ্য ও তত্ত্ব
আগে বিতর্কের বিষয় পেলে আমরা বই পড়ে বিষয়টিকে তত্ত্বের পাটাতনে বসানোর চেষ্টা করতাম। তখন তথ্যের আধিক্য ছিল না বা সুযোগ ছিল না এখন ইন্টারনেট বা বিশেষত ‘গুগল’-এর সাহায্যে আমরা অজস্র তথ্য কম্পিউটার বা স্মার্টফোনের পর্দায় পেয়ে যাই। বাছবিচার করার ক্ষমতা থাকে না। ঠেসে তথ্য বোঝাই করি। যুক্তির লালিত্য হারিয়ে যায়—হারিয়ে যায় তত্ত্বের ক্ষমতাশালী অবস্থান। যদি বিষয় হয় শ্রমিকের বিশ্বব্যাপ্ত মুক্তবাজার সম্ভব নয়’, তাহলে এর পেছনে মনস্তাত্ত্বিক কিছু তত্ত্ব কাজ করে—কাজ করে জাতীয়তাবাদ ও সংস্কৃতি সম্পৃক্ততার তত্ত্ব। এগুলো মনে চিন্তার আসন দেয়—পোক্ত করে যুক্তির অবস্থান ।
মাত্র এক ঘণ্টা আগে বিষয় দিলে ছাত্ররা পাগলের মতো খুঁজতে থাকবে তথ্য । সব অ্যাপস বা সার্চ ইঞ্জিন ব্যস্ত হয়ে পড়বে—কত শ্রমিক কোন দেশ থেকে কোথায় গিয়েছে, কত তারিখে গিয়েছে এবং দ্রুত বাগিয়ে নিতে হবে কেন গিয়েছে। এসব তথ্যের জাত নেই, অনেক সময় দুপক্ষেই ব্যবহার করা যায়। চলে আসে যুক্তিশাস্ত্রের অগভীরতা। তথ্যের ঘনবসতি অপেক্ষা এক বা দুটো তত্ত্বের স্বল্পবসতি অনেক বেশি উদ্বুদ্ধকারক, যদিও দুটোরই মিশ্রণ বিতর্কে উৎকর্ষে সহায়ক ।
বিতর্কে পোশাক
এটা পোশাকি শিল্প নয়। তবে মার্জিত পোশাকের আবেদন রয়েছে। তিনজনের ত্রিবর্ণের বিচিত্র পোশাক দৃষ্টি বিক্ষিপ্ততা ঘটাতে পারে। বিষয়বস্তুর ভাবের সঙ্গে সংগতি রেখেও পোশাক পরা যায়। যদিও পোশাকের আলাদা নম্বর থাকে না, এ ব্যাপারে যত্নবান হলে বক্তা সে রকম নম্বর পরোক্ষভাবে পান। লাভ বিনে ক্ষতি নেই । বিতর্কে উৎকর্ষের এই বিষয়গুলো বক্তা আমলে নিলে উপকৃত হবেন এবং বিতর্কশিল্পকে আরও আকর্ষণীয় ও শিক্ষাপ্রদ করে তুলবেন বলেই আমার বিশ্বাস ।
