বিতর্কের বিচারপদ্ধতি

আজকে আমরা বিতর্কের বিচারপদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করবো।

 

বিতর্কের বিচারপদ্ধতি
বিতর্কের বিচারপদ্ধতি

 

বিতর্কের বিচারপদ্ধতি

এ রচনার উদ্দেশ্য হচ্ছে বিতর্কে প্রচলিত বিচারপদ্ধতির সংস্কার ও উন্নয়ন। প্রচলিত সব কটি নিয়মই যে সংস্কারের দাবি রাখে, তা নয়। তবে তা যথাযথ পালিত হচ্ছে কি না, সে বিষয়েও আমাদের সচেতন থাকতে হবে।

ফুটবলও প্রতিযোগিতার বিষয়, বিতর্কও প্রতিযোগিতার বিষয়। কিন্তু ফুটবলের সঙ্গে এর পার্থক্য হচ্ছে, ফুটবল খেলায় এক পক্ষ আরেক পক্ষকে গোল দিতে পারলেই জয়-পরাজয় নিশ্চিত হয়ে যায়। এটা প্রত্যক্ষ, দৃশ্যমান । খেলার শেষে রেফারির ব্যক্তিগত মতামত ও ঘোষণার জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। কিন্তু বিতর্কে তা নয়। এক পক্ষ ভালো বললেও নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না যে সে পক্ষ বিজয়ী হবে। বরং, অনেক ক্ষেত্রেই প্রত্যাশিত ফলাফল দর্শক- শ্রোতারা পান না; এখানেই শুরু হয় আরেক অপ্রীতিকর তর্কাতর্কি। এর ফলাফলগুলো নিম্নরূপ

১. বিতর্কের বিচারকদের ওপর শ্রদ্ধা ও আস্থা নষ্ট হয় ।

২. প্রতিশ্রুতিশীল বিতার্কিকদের ভবিষ্যৎ-বিতর্কচর্চার ওপর অনীহা সৃষ্টি হয় ।

৩. অপ্রত্যাশিতভাবে যাঁরা জয়ী হন, তাঁরাও সঠিক অর্থে বিচারিক মান পরিমাপ করতে পারেন না। এ থেকে তাঁদের মধ্যে ভ্রান্ত অহংকার সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক, যা তাঁদের ভবিষ্যৎকে দুর্বল করে দেয়।

৪. দর্শক-শ্রোতারা লাভ করেন অতৃপ্তি, যা থেকে সৃষ্টি হয় অসন্তোষ এবং “বিতর্ক” বিষয়টির ওপরই এক নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। এই অনাকাঙ্ক্ষিত ফলাফলগুলো যত দূর সম্ভব এড়ানোর লক্ষ্যে বিচারকদের বিচারপদ্ধতির ওপরও কিছু নীতিমালা আরোপ করা প্রয়োজন ।

কেউ হয়তো বলবেন, এটা বিচারকের সম্মান ও স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ । মোটেও তা নয়, আসলে এটা বিচারকদের উচ্ছৃঙ্খলতার ওপর একটি হস্তক্ষেপ। এ ক্ষেত্রে বিচারকের স্বাধীনতার সংজ্ঞাটি আঠারো শতকের ফরাসি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মর্তেস্কর ভাষা থেকেই তৈরি হয়, এভাবে স্বাধীনতা হচ্ছে সেই অধিকার, যা আইন অনুমোদন করে।

এই আইন বা নীতিমালা আমরা বিতর্কের বিচারকদের ওপর প্রয়োগ করতে চাই না—মনে হয় অনেকটা সম্মানবোধ থেকে। কিন্তু তা কাম্য নয়। দেশের সর্বোচ্চ বিচার বিভাগ তথা সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা যথেষ্ট সম্মানিত ব্যক্তি, কিন্তু তাঁদের সুনির্দিষ্ট আইন মেনে চলতে হয়। অন্যথায়

বিচারপতি, তোমার বিচার করবে যারা
আজ জেগেছে সেই জনতা।

দ্বিতীয়ত, তাঁদের বিচারের রায় সম্বন্ধে ব্যাখ্যা দিতে হয়। প্রতিটি ঘোষণার জন্য জবাবদিহি করতে হয় ৷ অথচ বিতর্কে বিচারকদের এ রকম জবাবদিহিমূলক অবস্থা গড়ে তোলা হয়নি । যেকোনো অবস্থায় বিচারকের রায়ই চূড়ান্ত’-এ ঘোষণাটা বিচারকদের একটা সার্বভৌম অধিকারের ইঙ্গিত দিচ্ছে। কিন্তু কোনো অধিকারই দায়িত্ব ও কর্তব্য ছাড়া সৃষ্টি হতে পারে না। বিতর্কে বিচারকের এই দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পাদনের পূর্বশর্ত হচ্ছে একটি জবাবদিহিমূলক পদ্ধতির অস্তিত্ব।

তাই বলে প্রতিটি বিতর্কের শেষে যদি প্রত্যেক বিচারককে তাঁদের নম্বর প্রদানের ক্ষেত্রে জবাবদিহিমূলক বক্তব্য রাখতে বলা হয়, তাহলে খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি হবে। যেটা করা হবে তা হলো, নম্বরপত্রটি যথেষ্ট দীর্ঘ হবে এবং প্রতিটি নম্বরের ঘরের পাশাপাশি একটি করে মন্তব্যের ঘর থাকবে, যেখানে বিচারক কাউকে নম্বর দিলে, বাড়ালে বা কমালে তার সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা লিখবেন।

 

বিতর্কের বিচারপদ্ধতি
বিতর্কের বিচারপদ্ধতি

 

বিতর্ক প্রতিযোগিতা পরিমাণগত জনপ্রিয়তার মাপমাঠিতে হয়তো হাঁকডাক পড়ার বিষয় নয়, কিন্তু গুণগত বিচারে এই শিক্ষামূলক চর্চাটি ব্যাপকভাবে গুরুত্ববহ। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও এখন বিতর্কে অংশগ্রহণ করছে। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমাদের প্রচারমাধ্যমগুলোকে জাতীয়ভাবে শিক্ষামূলক ও অর্থবহ করা যায়।

যেকোনো বিদ্যারই বিচারপদ্ধতি যদি সঠিক না হয়, তবে সে বিদ্যা বা চর্চা সঠিকভাবে সুস্থ পথে বিকশিত হতে পারে না। সংগীতশাস্ত্রকে বিচার করার জন্য নির্দিষ্ট ব্যাকরণ বা নিয়মাবলি রয়েছে। কিন্তু বিতর্কশাস্ত্রের কোনো নির্দিষ্ট লিখিত নীতিমালা গড়ে ওঠেনি বলে এ ক্ষেত্রে রয়েছে কিছুটা নৈরাজ্য। টেলিভিশনের সম্মানিত বিচারকেরা অনেকেই যার যার ব্যক্তিগত ধ্যানধারণার ওপর ভিত্তি করে নম্বর দিয়ে যাচ্ছেন। অধিকাংশ সময়েই দেখা যায়, নির্মোহ দর্শক-শ্রোতা একেবারে আশ্চর্যজনকভাবে উল্টো ফল দেখতে পান। এতে শুধু বিচারপদ্ধতির ওপরই মানুষের ধারণা ক্ষুণ্ণ হয় না, উপরন্তু তার্কিকেরাও হতাশ হয়ে বিকৃত ধারায় বিতর্কচর্চা শুরু করেন।

নব্বইয়ের দশকে টেলিভিশনের পর্দায় এ রকম চিত্রও দেখা যেত, এক পক্ষ তার প্রতিপক্ষকে হীন ভাষায় ব্যক্তিগত আক্রমণ করল, প্রতিপক্ষ মেয়ে হলে হয়তো সামন্ত পৌরুষের আদলে তাদের গল্পচ্ছলে প্রেম নিবেদন করে বসল. ধর্মীয় আবেগে শোষণ করল, প্রতিপক্ষের চেহারা নিয়েও একটু কটাক্ষ করল, নিম্নরুচির কৌতুক করে তাত্ক্ষণিক হাততালিও পেল। অথচ বিচারে তাদের কোনো ক্ষতি তো হলোই না, বরং সদর্পে বিজয়ী হয়ে তারা প্রকারান্তরে এটাই বুঝিয়ে দিল, ‘বিতর্কের আর্ট এ রকমই হওয়া উচিত।’ আপাতত দোষ বিচারকদের হলেও প্রকৃতপক্ষে তারা অসহায়। কারণ কোনো নির্দিষ্ট লিখিত সুবিন্যন্ত বিচার নীতিমালা তাঁরা পাচ্ছেন না, যার ওপর ভর করে তাঁরা রায়কে চ্যালেঞ্জমুক্ত করবেন।

বিচারকের মতো অসহায় পরাজিত পক্ষও, তারা পারছে না সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এনে ধারা উল্লেখপূর্বক রায়কে চ্যালেঞ্জ করতে। আগে টেলিভিশন থেকে বিচারকেরা যে নীতিমালা পেতেন তা আসলে উপস্থাপন, বাচনভঙ্গি, উচ্চারণ, যুক্তিপ্রদান, যুক্তিখণ্ডন, তত্ত্ব ও তথ্য প্রভৃতি বিষয়ে নম্বর বণ্টন ছাড়া অতিরিক্ত কিছুই নয়। এই নম্বর বণ্টনকে ইচ্ছামতো কমানো-বাড়ানো যায়। একে নীতিমালা বলা চলে না। যুক্তি প্রদানে যদি ১০ নম্বর থাকে, তাহলে বিচারকের ইচ্ছা তিনি ১ দেবেন না ৯ দেবেন, অথবা চরমপন্থীদের ক্ষেত্রে শূন্য দেবেন না ১০ দেবেন। অর্থাৎ, বিচারককে শুধু একটি বিষয়েই সতর্ক থাকতে হবে, তিনি কক্ষনো ১০-এর মধ্যে ১১ বা তদূর্ধ্ব নম্বর দেবেন না। এ থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট, আমাদের দরকার বিতর্ক-বিচারে একটা সুবিন্যস্ত নীতিমালা ।

ঘোষিত ফলাফল আশানুরূপ হলে কখনোই দর্শক-শ্রোতা বা বিতার্কিকেরা কলহ করেন না। খেলার মাঠের দর্শকদের সঙ্গে এখানকার দর্শক-শ্রোতাদের একটা গুণগত পার্থক্য রয়েছে এবং চিরদিনই থাকবে, কারণ এটা বুদ্ধি, যুক্তি ও মেধার লড়াই। কিন্তু ফলাফল একেবারে বিপরীত হলে তখন এই জবাবদিহিমূলক ব্যাখ্যাগুলো প্রকাশ করতে হবে। এইটুকু চিন্তা যদি বিচারকদের মাথায় থাকে, তাহলে তাঁরা আরও দায়িত্ববান হবেন এবং অবিচারের অভিযোগ বৈপ্লবিক হারে হ্রাস পাবে।

 

বিতর্কের বিচারপদ্ধতি
বিতর্কের বিচারপদ্ধতি

 

এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কতগুলো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা বিতর্কের প্রত্যেক বিচারকের মেনে চলা উচিত।

১. প্রথম বক্তার প্রতি যে অবিচার করা হয় তা হলো, ‘যুক্তিখণ্ডনে’ তাকে কোনো নম্বর না দেওয়া। এতে সে ভালো বক্তা হওয়া সত্ত্বেও যথার্থ নম্বর পায় না। অনেক ক্ষেত্রে টসের মাধ্যমেও কাউকে প্রথম বলতে হয়। তা ছাড়া একেবারে প্রথম বক্তার অপেক্ষাকৃত কম নম্বরের জন্য বিষয়বস্তুর পক্ষদল পরাজিত হয়. এটা যুক্তিযুক্ত নয়। অনেক বিচারকের অভিযোগ, সে তো বিপক্ষের রেফারেন্স তুলে যুক্তি কাটেনি । কিন্তু আইন ‘যা ঘটেছে’ শুধু তা নিয়েই আলোচনা করে না, উপবন্ধ ‘যা ঘটতে পারত’ সেটাও বিবেচ্য। অর্থাৎ এই বক্তা পরে বললে যুক্তি খণ্ডন করতে পারত।

এ ক্ষেত্রে ন্যূনতম মাপমাঠি হচ্ছে- সে যদি যুক্তি প্রয়োগে ৬-এর মধ্যে ৩ পায় (৫০%), তবে সে যুক্তিখণ্ডনের জন্য ধার্য ৮-এর মধ্যে অনধিক ৪ পাবে। এতে যদি সামান্য অবিচারও হয়, তাহলে ৮-এর বিপরীতে তাকে শূন্য দেওয়া কি মহা অবিচার নয়? এই ধারার পরিবর্তন না হলে সবাই প্রথম বক্তা হতে অনীহা প্রকাশ করবে, অথবা ‘হাসি হাসি পরব ফাঁসি’—এ রকম একটা দুঃখবোধ ও হতাশা নিয়েই মঞ্চে উঠবে।

২. কোনো বিশেষজ্ঞ বিচারক তাঁর বিশেষায়িত ক্ষেত্রেই শুধু নম্বর প্রদান করবেন। উচ্চারণ বিশেষজ্ঞ শুধু উচ্চারণেই নম্বর দেবেন। উচ্চারণ বিশেষজ্ঞ সাবেক বিতার্কিক কি না, এটা বিবেচ্য নয়। কিন্তু তাঁকে দিয়ে অন্য বিষয়ে নম্বর দেওয়া হলে তা সঠিক বিচারকে ঝুঁকিপূর্ণ করে। তুলতে পারে ।

৩. উচ্চারণের ঘরে নম্বর বাধা আছে; ধরুন, উচ্চারণ খারাপ হলে বিতর্কের যথেষ্ট ক্ষতি হয়, এ ক্ষেত্রে বিচারক তাকে উচ্চারণের ঘরে শূন্য দিতে পারেন, কিন্তু যুক্তিপ্রয়োগ, খণ্ডন, তথ্য—এ ঘরগুলোতে তাঁর প্রভাব খাটিয়ে যাচ্ছেতাই নম্বর দিতে পারেন না, বক্তা যদি ভালোভাবে এ উপাদানগুলো সরবরাহ করে। তবে হ্যাঁ, এ ক্ষেত্রে বিচারক ‘সামগ্রিক শীর্ষক ঘরে প্রভাব ফেলতে পারেন, নম্বর কমাতে পারেন। সামগ্রিক শীর্ষক ঘরে বিচারকের নিজস্ব প্রবণতা ক্রিয়াশীল বলে এখানে বিচারকের স্বাধীনতার মাত্রা বেশি।

৪. বিচারক নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিতর্কের অভিজ্ঞতা ও পেশাগত দিক এবং বিতর্কের সঙ্গে বর্তমান যোগাযোগ প্রভৃতি বিষয়কে প্রাধান্য দিতে হবে। শিল্প-সাহিত্যের যেকোনো শাখায় বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে পেশাদারত্ব ও সংশ্লিষ্ট জ্ঞানের গভীরতাকে প্রাধান্য দেওয়া হয় এবং এটাই নিয়ম। কিন্তু বিতর্ক বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে আমরা যথার্থভাবে এ নিয়ম মানি না।

৫. বিতর্কের অভিজ্ঞতা না রেখেও জ্ঞানী-গুণী ও পণ্ডিত ব্যক্তিরা বিতর্ক বিচারক মণ্ডলীতে অন্তর্ভুক্ত হবেন, যারা একান্তভাবে তত্ত্ব, তথ্য, রস, শ্লেষ, সাহিত্যবোধ প্রভৃতিতে নম্বর প্রদান করবেন। এ ক্ষেত্রে বিষয়বস্তুর সঙ্গে সংগতি রেখে সেসব ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের তাৎক্ষণিকভাবে বিচারক মণ্ডলীতে অন্তর্ভুক্ত করা যুক্তিযুক্ত। যেমন পরিবেশের ওপর বিতর্ক হলে বিচারক মণ্ডলীর সঙ্গে দুজন পরিবেশবিজ্ঞানীকে বা এ ধারার সাংবাদিককে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।

৬. বিতর্কের স্থায়ী বিচারক মণ্ডলীতে কেবল প্রাক্তন দক্ষ ও যথেষ্ট অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বিতার্কিকেরাই অন্তর্ভুক্ত থাকবেন, যারা শুধু সব বিষয়ে নম্বর দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। কারণ, এসব বিষয়ে উত্তীর্ণ হয়েই তিনি বা তাঁরা দক্ষ বিতার্কিক হয়েছেন।

৭. নম্বর প্রদানের ক্ষেত্রে নিম্নমাত্রা এবং উচ্চমাত্রা থাকতে হবে, যার নিচে নামলে বা ওপরে উঠলে বিচারককে লিখিত ব্যাখ্যা দিতে হবে।

 

বিতর্কের বিচারপদ্ধতি
বিতর্কের বিচারপদ্ধতি

 

৮. সর্বনিম্ন নম্বর ৮ এবং সর্বোচ্চ নম্বর ধরুন ২৫। কিন্তু বিচারক ইচ্ছা করলেই ২৫ বা ৮ কোনোটিই দিতে পারেন না। নম্বর ১০-এর নিচে বা ২০-এর ওপরে হলেই সুস্পষ্ট জবাবদিহি করতে হবে। প্রতিটি অফিস- আদালতেও এসিআর বা বার্ষিক গোপন মূল্যায়নের বেলায় এ নিয়ম রয়েছে। সেখানে পরমোৎকৃষ্ট বা অতিনিম্ন—এ দুটো ক্ষেত্রেই ব্যাখ্যা দিতে হয় ।

৯. নম্বর প্রদানের যে হার, সে ক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরীক্ষকদের উত্তরপত্রে নম্বর প্রদানের পদ্ধতিটি অবলম্বন করা উচিত। এ ব্যাপারে বিতর্ক-বিশেষজ্ঞদের সুচিন্তিত পরামর্শ ও অনুমোদন অনুযায়ী একটি নম্বর বিতরণপত্র প্রণয়ন করা উচিত।

১০. ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে যদি আলাদা নম্বর থাকে, তাহলে সে ক্ষেত্রে সহজ-সরল কথ্য ভাষাকে উৎসাহিত করা উচিত। প্রবন্ধোপযোগী ভাষার অধিক ব্যবহার থাকলে বিচারক সেখানে কম নম্বর দিতে পারেন। বিতর্ক হচ্ছে একটি যোগাযোগ বিদ্যা। একে কার্যকর করে তুলতে হলে মনস্তাত্ত্বিক গানিংয়ের উপদেশ অস্বীকার করার উপায় নেই। তিনি যে ১০টি উপদেশ আমাদের জন্য রেখে গেছেন, তার অন্যতম কটি হলো

ক) সহজ ভাষা ব্যবহার করুন।

খ) বাক্য সংক্ষিপ্ত করুন।

গ) পরিচিত শব্দ ব্যবহার করুন।

ঘ) ভাষায় বিমূর্ত শব্দ এড়িয়ে চলুন।

ঙ) ভাব প্রকাশে ভাষা ব্যবহার করুন, মুগ্ধ করার উদ্দেশ্যে নয়।

১১. দলপতি বা দলনেত্রীর প্রতি প্রথমেই আলাদা ধারণা বিচারকদের মধ্যে সৃষ্টি হওয়া উচিত নয় । অনেক বিচারকের ধারণা, দলপতিকে শ্রেষ্ঠ বক্তা না বানালে তাঁদের বিশ্বাসযোগ্যতা থাকবে না। এটা ঠিক নয়। কারণ, দলপতি নির্ধারিত হয় অনেক সময় দলগুলোর অভ্যন্তরীণ বোঝাপড়ায়, অনেক সময় বয়সের জ্যেষ্ঠতা দিয়ে, অনেক সময় রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনগুলোর চাপে, অনেক সময় কর্তৃপক্ষের পক্ষপাতিত্বে আবার অনেক সময় দলের অভ্যন্তরীণ টসে। এ দিকগুলো বিচারকদের জানা সম্ভব নয়, দরকারও নেই। অনেক সময় দলপতি দলের সর্বনিম্ন নম্বরও পেতে পারেন এবং পান।

১২. পরিচিত মুখের প্রতি মুগ্ধতাও বিচারকের আরেকটি ব্যাধি। তা ছাড়া রাজধানীর নামকরা কলেজ বনাম জেলা-উপজেলা পর্যায়ের একটি শহীদ স্মৃতি কলেজের মধ্যে বিতর্ক হলে বিচারক আগেই ‘রাজধানীর কলেজ ভালোই তো বলবে’, এমন একটা পূর্বধারণায় ভোগেন। এগুলো থেকে আত্মশাসনের মাধ্যমে বিচারককে মুক্ত থাকতে হবে।

১৩. বিষয়বস্তু শোনার সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেকেই মনে মনে একটা দিকে নৈতিকভাবে ঝুঁকে পড়েন। যেমন রাষ্ট্রায়ত্তকরণ বা বিরাষ্ট্রায়ত্তকরণ শীর্ষক বিতর্ক। বিচারকও মানুষ, তাঁরও একদিকে নৈতিক দুর্বলতা এসে যায়। কিন্তু এই দুর্বলতা যদি প্রকৃতপক্ষে উপযুক্ত নম্বর দিতে তাঁর হাতকে দুর্বল করে ফেলে, তাহলে তিনি বিচারক নন, মৌলবাদী। মৌলবাদীরা রাজনীতি করুন আর নৈরাজ্যই করুন, অন্তত বিচারক হতে পারেন না।

১৪. দর্শক-শ্রোতাদের প্রবল সমর্থন ও হাততালি পড়লেও তা যেন বিচারককে অন্ধভাবে প্রভাবিত না করে। অনেক সময় এক পক্ষের কোনো দর্শক-শ্রোতা থাকেন না বা আসতে পারেন না। তখন দর্শক- শ্রোতা রয়েছেন শুধু এক দলের। ফলে তাদের মধ্যে যৌক্তিক প্রতিক্রিয়া ঘটবে না, এটাই স্বাভাবিক।

 

১৫. টেলিভিশনে বিচারকদের অনেকটা গা ঘেঁষে বসানো হয়। আমরা এমন কথা বলব না, যাতে একজন বিচারক তাঁর পাশের জনের নম্বরপত্র দেখে প্রভাবিত হন, কিন্তু পাশের নম্বরপত্র দেখার যে সুযোগ পান, এটাই অনৈতিক। বিচারকদের খানিকটা দূরে বসানোই শ্রেয়।

১৬. অনেক বিচারক বিতর্ক চলাকালে আশপাশে টুকটাক কথা বলেন, অথবা চুপ করে বসে থেকে এমন ভাব দেখান যে তিনি সব শুনছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা থাকে আলস্য। ফলে বক্তা যখন নেমে যান, তখন বিচারক একটা দায়সারা মোট নম্বর বসিয়ে দেন। আসলে বক্তার তীক্ষ্ণ চেতনার মতো বিচারককেও থাকতে হবে তীক্ষ্ণ ও সদা ব্যস্ত, হয় শ্রবণে না হয় লিখনে। বিশ্বকাপ ফুটবলের রেফারিদের মতো।

প্রতিটি যুক্তির জন্য, তথ্যের জন্য, তত্ত্বের জন্য বা খণ্ডনের জন্য তাঁকে সঙ্গে সঙ্গে নম্বর দিতে হবে এবং দ্রুত পাশে মন্তব্য লিখতে হবে, মোট নম্বরের ব্রেকআপ দিতে হবে। এটুকু কষ্ট স্বীকার করতেই হবে বিচারককে। কারণ পদটি যে যথেষ্ট কষ্টের, যোগ্যতার, সম্মানের ও দায়িত্বের। বিতর্কে যাঁদের পূর্ব অভিজ্ঞতা রয়েছে, সেই বিচারকেরা আশা করি এটুকু কষ্ট মেনে নেবেন ও নিচ্ছেন সানন্দে। কারণ, গণতান্ত্রিক যুগে সবকিছুই জবাবদিহিমূলক হওয়া বাঞ্ছনীয়।

১৭. সব পর্যায়ে না হলেও, কমপক্ষে সেমিফাইনাল থেকে ফাইনাল পর্যন্ত বিতর্ক তিনটিতে অসন্তোষজনক রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ দেওয়া উচিত। বিচারক মণ্ডলীর সর্বোচ্চ কমিটি এ আপিল পুনর্বিবেচনা করবে। এতে বিচারকেরাও যথেষ্ট সতর্কতার সঙ্গে এ পর্যায়গুলো বিচার করবেন।

১৮. সব দ্বিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতাতেই শাস্তির বিধান থাকে। কোনো অসুস্থ ধারায় বিতর্ক করলে, অপরকে হীন ভাষায় অপমান করলে, অপ্রয়োজনীয় বিভেদ করলে, দুর্বিনীত ভাষা ব্যবহার করলে বা সন্ত্রাসী ভাব প্রদর্শন করলে বিচারক যেন উপযুক্ত ব্যাখ্যাদানপূর্বক শাস্তিমূলক নম্বর কর্তন করতে পারেন। অন্যথায় অমার্জিত, অভদ্র ও অসহিষ্ণু উপাদানগুলো বিতর্কে ক্রমাগত চর দখল করবে। এ ধারাগুলো সংযোজন করলে বিতর্কের বিচারপদ্ধতি আরও সমৃদ্ধ হবে।

১৯. সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা বিচারককে প্রভাবিত করা উচিত নয় । তবে কোনো বক্তা রাষ্ট্রবিরোধী বা রাষ্ট্রের মূল চেতনাবিরোধী কথা বললে বিচারক বক্তাকে থামাতে বা বক্তব্য পরিবর্তন করতে বলতে পারবেন।

এ ধারাগুলো বিতর্কের বিচারপদ্ধতিকে আরও গ্রহণযোগ্য ও যৌক্তিক করে তুলবে বলেই আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। এমনকি এ ধারাগুলোরও পরিবর্তন, পরিবর্ধনকে আমরা স্বাগত জানাব। কিন্তু সবকিছুই করতে হবে বিতর্কের বিচারপদ্ধতিকে আরও জবাবদিহিমূলক, গতিশীল ও আধুনিক করার লক্ষ্যে, মাপমাঠিতে।

Leave a Comment