আজকে আমরা বিতর্কের নাট্য মডেল সম্পর্কে আলোচনা করবো।

বিতর্কের নাট্য মডেল
যুক্তি বুদ্ধির নাটকীয় মঞ্চায়ন
বিতর্ককে আনন্দের পথে শিক্ষণীয় করে তুলতে এ পর্যায়ে নাটকীয়তা-সমৃদ্ধ বিতর্কের কথা বললাম। চর্চা ও নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে এ ধারার গুণগত উন্নয়ন সম্ভব। এতে আছে অভিনয় ও শৈল্পিক দক্ষতা। কিন্তু এর ফল্গুধারায় প্রবাহিত হচ্ছে তথ্য ও জ্ঞানের বারিধারা । সংক্ষেপে এই নাট্য মডেলের (Drama Model) আলোচনা নিবেদিত হলো।
নাটকীয় সংলাপের ধাঁচে পরস্পরের প্রতি প্রশ্ন, শ্লেষ, রস, অভিযোগ, খণ্ডন প্রভৃতির মাধ্যমে এই বিতর্ক সম্পাদিত হয় ৷ এই বিতর্কের বিচার কঠিন কাজ। পুরো অনুষ্ঠান শেষে সামগ্রিক ধারণার ওপর ভিত্তি করে নম্বর দেওয়া যেতে পারে । সময়ের ব্যাপারেও সীমরেখা টানা সম্ভব নয়। তা ছাড়া সম্মিলিত মহড়া এ বিতর্কের আকর্ষণ বাড়ায়। অতএব, কোনো প্রতিযোগিতার চেয়ে প্রীতি- বিতর্কে এ মডেল প্রয়োগ করা যায়।
কোনো ঐতিহাসিক ইস্যুতে দুজন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের মধ্যে এ বিতর্ক হতে পারে। এ ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ব্যক্তিদ্বয় তাঁদের নিজেদের সাজে মঞ্চে অবতীর্ণ হলেন, যা নাটকীয়তার স্বার্থে আবশ্যকীয়। তারপর সংলাপের মধ্য দিয়েই উভয়ের বিতর্ক হবে। বক্তাকে ওই ঐতিহাসিক চরিত্রগুলো সম্বন্ধে যথেষ্ট পড়াশোনা করতে হবে । এটি দুই পদ্ধতিতে হতে পারে—(ক) মধ্যস্থতাহীন, (খ) মধ্যস্থতাযুক্ত।
মধ্যস্থতাযুক্ত হলে ন্যায়পাল এটি পরিচালনা করবেন এবং একেকটি প্রশ্ন ন্যায়পালই উত্থাপন করবেন। বক্তারা তাঁদের যুক্তিবোধ ও ঐতিহাসিক জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে সংলাপ বলবেন । এটির পূর্ব-মহড়া জরুরি নয় । তবে ন্যায়পাল না থাকলে পূর্ব-মহড়া জরুরি হয়ে পড়ে এ বিতর্কের শ্রীবৃদ্ধির তাগিদে। মধ্যস্থতাহীন নাট্য বিতর্কের নমুনা আমরা নিচে উপস্থাপন করতে পারি মঞ্চে হালকা আলো। টেবিলে বসে সিরাজ হাতের আংটিগুলো দেখছেন। মঞ্চের বাইরে চিৎকার।

নবাব সিরাজদ্দৌলা বাড়িতে আছেন কি?
সিরাজ :
জি, কে বলছেন? লর্ড ক্লাইভ বুঝি, ভেতরে আসুন। (পরস্পর শুভেচ্ছাসূচক অভিবাদন ও কথাবার্তার পর আসন গ্রহণ করবেন।) আমি আসলে আপনাকে ডেকেছি অন্য একটা কারণে। ১৭৫৭ সালে স্বাধীন বাংলার শেষ সূর্য অস্তমিত হয়। তারপর দুইশত বছর ব্রিটিশরা ভারতকে গোলামির শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে রাখে। ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান নামে ভারত দ্বিখণ্ডিত হয়। ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান বাংলাদেশ নামে স্বাধীনতা অর্জন করে। সে দেশে স্বাধীনতা অর্জনের পর আজ দুই যুগ অতিবাহিত। কিন্তু আজও একটি বিষয়ে বিতর্ক আমার কানে আসে। ব্রিটিশ শাসন ভারত উপমহাদেশকে আরও পেছনে ঠেলেছে নাকি এগিয়ে নিয়েছে–এ প্রশ্ন কেন আজও উত্থাপিত হয়?
ক্লাইভ :
অবশ্যই হবে। কারণ, ব্রিটিশ শাসন না এলে ভারত আজও সামন্তযুগের অন্ধকারে বাস করত। অর্থনৈতিকভাবে তারা পঙ্গু হয়ে পড়ত।
সিরাজ :
অসম্ভব। আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, ব্রিটিশ শাসন ভারতকে পেছনে ঠেলেছে। আমাদের সামন্তবাদ থেকে মুক্তি দেওয়ার মহান লক্ষ্য নিয়ে ব্রিটিশরা আক্রমণ করেনি। তারা এসেছিল ভারতকে শোষণ করতে লর্ড। শোষণ কখনো কোনো জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যায় না।
ক্লাইভ :
হে নবাব! আপনার ধারণা ভুল। ব্রিটিশ শুধু শোষণই করেনি, শোষণের চেয়ে ভারতের উপকারই বেশি করেছে। ভারতে দিয়েছে শিক্ষার আধুনিক আলো, নির্মাণ করেছে অসংখ্য রেলপথসহ বিস্তৃত কাঠামো। ব্রিটিশ শাসন ভারতকে অবশ্যই এগিয়ে নিয়েছে।
সিরাজ :
কিন্তু এই রেলপথ নির্মাণের উদ্দেশ্যও ছিল শোষণ। শিক্ষিত করেছে একটা তাঁবেদার আমলা ও অনুরাগী শ্রেণি সৃষ্টির লক্ষ্যে….
এভাবে বিভিন্ন সংলাপের পারম্পর্য ও উত্তাপে বিতর্কটি এগিয়ে নিয়ে যাবে; যুক্তি যার প্রাণ, ইতিহাস যার অলংকার। এতে সংলাপ ও অভিনয় ইতিহাসকে পুরোপুরিভাবে হয়তো ধারণ করতে পারবে না, তবে যত দূর সম্ভব ইতিহাস ও নাটকীয় আশ্রয়ে বিতর্কচর্চা শাণিত হবে। নাট্য বিতর্কের নমুনা ও উদাহরণ লেনিন বনাম মাও সে তুং ও কিনস বনাম ফ্রিডম্যান। ইতিহাস, অর্থনীতি, বাড়ানো সহজ। যেমন রবীন্দ্রনাথ বনাম নজরুল, রবিশংকর বনাম জ্যাকসন, সমাজবিদ্যা, রাজনীতি সাহিত্যের বিষয়গুলো যুক্তি ও বুদ্ধির সংমিশ্রণে নাটকীয়তার আনন্দে শিক্ষণীয় হয়ে উঠবে এই নাট্য মডেলে।
