বিতর্কের তত্ত্বীয় দিক

আজকের আলোচনার বিষয়ঃ বিতর্কের তত্ত্বীয় দিক

 

বিতর্কের পুঞ্জ মডেল
বিতর্কের পুঞ্জ মডেল

 

Table of Contents

বিতর্কের তত্ত্বীয় দিক

অর্থনৈতিক ভিত্তি ছাড়া কোনো শিল্প বা কলা টিকে থাকতে পারে না। তবে শিল্পের তাত্ত্বিক ভিত্তি হচ্ছে তার অর্থনৈতিক ভিত্তি সৃষ্টির পূর্বশর্ত। তত্ত্বগত দিকের সমৃদ্ধির সঙ্গে বাস্তবের সফল প্রয়োগ যুক্ত হলেই তা হবে এক শক্তিধর শিল্প। ভালো বিতার্কিক হতে হলে তাকে যে বিতর্কের গভীরের তত্ত্ব জানতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। ভোগাই কিংবা মধুমতী নদীতে যে মাঝি সুরেলা কণ্ঠে ভাটিয়ালি গাইছে, সে ভাটিয়ালির ব্যাকরণ জানে না। ইন্দ্রনাথ স্বরবিজ্ঞানে কোনো সনদ না নিয়েই বাঁশি বাজাত। কিন্তু ব্যাকরণ জানা যে শিল্পী খুলনা বেতারে ভাটিয়ালি গাইছে, তার সঙ্গে ভোগাইয়ের মাঝির পার্থক্য অনেক। পার্থক্য অনেক ইন্দ্রনাথের সঙ্গে হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়ার।

বাংলাদেশে বিতর্কচর্চার ধারাবাহিকতা অনেক পুরোনো হলেও এ ক্ষেত্রে প্রকাশনা বা তাত্ত্বিক দিকের বিকাশ ঘটেনি। সংগীত, নাটক, নৃত্য বা মূকাভিনয়ে তাত্ত্বিক দিক যতটা সমৃদ্ধ, বিতর্কের ক্ষেত্রে তার একাংশ বিকাশও ঘটেনি । এটি বিতর্কের ভারসাম্যপূর্ণ বিকাশ প্রমাণ করে না। আজ প্রায় প্রতিটি শিক্ষাঙ্গনে বা সাংস্কৃতিক বলয়ে বিতর্ক যখন ক্রমবর্ধমান চাহিদার শিল্প হয়ে দাঁড়াচ্ছে, তখন এর শাস্ত্রীয় ও তাত্ত্বিক দিকগুলোর বিকাশ প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। সে লক্ষ্যেই এ প্রয়াস।

বিতর্কের সংজ্ঞা

বিতর্ক হচ্ছে একটি উদ্বুদ্ধকরণ শিল্প, যা প্রাসঙ্গিক যুক্তি-প্রমাণাদিসহ দ্বান্দ্বিক বক্তৃতায় কোনো সুনির্দিষ্ট মত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রকাশিত হয়।

Debate is an art of motivation expressed in a dialactic speech with relevant arguments and evidence directed to establish a definite opinion.

 

বিতর্কের উপাদান

১. বিষয়বস্তু:

যাকে কেন্দ্র করে বিতর্কে বিভাজন সৃষ্টি হয় কিংবা যে ধারণার পক্ষে বা বিপক্ষে বক্তারা বক্তৃতা করে থাকেন, তাকে বিষয়বস্তু বলে।

২. বিতার্কিক:

যে বক্তা সাধারণত বিষয়বস্তুর পক্ষে বা বিপক্ষে বিতর্ক করতে প্রস্তুত, তাকে আমরা বিতার্কিক বলি।

৩. যুক্তি ও প্রমাণাদি:

বিষয়বস্তুর পক্ষ বা বিপক্ষ মতকে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিতার্কিক যেসব সহযোগী তত্ত্ব, তথ্য বা ন্যায়বোধের অবতারণা করে থাকেন, তাকে যুক্তি ও প্রমাণ বলে । এটিই বিতর্কের মূল শক্তি।

৪. উদ্বুদ্ধকরণ:

এটিই বিতর্কের উদ্দেশ্যমূলক অদৃশ্য উপাদান। দর্শক-শ্রোতাকে নিজের মতের পক্ষে প্ররোচিত বা রাজি করানোকে উদ্বুদ্ধকরণ বলে। এখানেই বিতর্কশিল্পের চরম সার্থকতা। নিজের মতের পক্ষে উদ্বুদ্ধকরণের লক্ষ্যেই বিতার্কিক নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিভিন্ন যুক্তি ও প্রমাণ যথাসম্ভব চমৎকার বাচনভঙ্গির সাহায্যে শুদ্ধ উচ্চারণে বাগদক্ষতায় উপস্থাপন করে থাকেন । এসব আবশ্যকীয় উপাদান ছাড়াও প্রচলিত বিতর্কে কিছু ঐচ্ছিক বা ততটা আবশ্যকীয় নয় এমন উপাদানও রয়েছে।

৫ বিচারকমণ্ডলী

৬. সভাপতি বা পরিচালক

৭. দর্শক ও শ্রোতা

৮. সময়রক্ষক

৯. হিসাবরক্ষক

১০. ঘোষক

১১. বিচারের রায় ইত্যাদি।

বিতর্কের শর্তাবলি

প্রকৃতপক্ষে বিতর্কের সংজ্ঞার মধ্যেই এর শর্তাবলি নিহিত ।

১. সুনির্দিষ্টতা :

সুনির্দিষ্টতা ছাড়া বিতর্ক আর ঝগড়াবিবাদ কিংবা কথোপকথনের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। বিষয়বস্তুর কোনো সুনির্দিষ্ট দিকে বিতার্কিককে অবশ্যই অবস্থান নিতে হবে। অন্যথায় তার বক্তৃতা অনেকটা সভাপতির ভাষণে পরিণত হবে।

২. দ্বান্দ্বিকতা:

একই মঞ্চে থাকতে হবে দ্বিমুখী শক্তির দ্বন্দ্ব। বিতর্কের আকর্ষণই এখানে। অন্যথায় বক্তার বচন কোনো রাজনৈতিক নেতার একপেশে জ্বালাময়ী ভাষণে পরিণত হবে।

৩. প্রাসঙ্গিকতা:

বক্তা যেসব যুক্তি-প্রমাণ হাজির করবেন, তার প্রতিটিङ সম্পূর্ণভাবে প্রাসঙ্গিক হতে হবে। অনেক বক্তা শুরুতে কবিতা, গান বা গল্প বলেন। সেটা প্রাসঙ্গিক না হলে বক্তাকে শাস্তি পেতে হয়।

৪. উদ্বুদ্ধকরণ:

এটি একই সঙ্গে বিতর্কের উপাদান ও শর্তে অবস্থান করে। বিতর্কের চূড়ান্ত লক্ষ্যই হচ্ছে দর্শক-শ্রোতাকে নিজের পক্ষে রাজি বা প্ররোচিত, অর্থাৎ উদ্বুদ্ধ করা। উদ্বুদ্ধকরণের শর্ত ছাড়া বক্তৃতা অনেকটা পাগলের কূটতর্কে পরিণত হয়। সামাজিক বক্তব্যসম্পন্ন নাটক, সংগীত, কবিতা, নৃত্য বা মুকাভিনয়েও উদ্বুদ্ধকরণের শর্ত নিহিত। কিন্তু অন্য যেকোনো শিল্পমাধ্যমের চেয়ে বিতর্কে উদ্বুদ্ধকরণ-প্রক্রিয়া সরাসরি প্রত্যক্ষ এবং অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন বলেই সভ্য দেশে প্রাক-নির্বাচনী বিতর্কের আয়োজন করা হয়। এ বিতর্কে নির্বাচনের প্রার্থীরা নিজের পক্ষে ভোট দিতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেন।

মূলত এ চারটি শর্ত ছাড়া বিতর্ক পূর্ণাঙ্গ হয় না। একে বলা হয় বিতর্ক বিনির্মাণের চার স্তম্ভ।

 

বিতর্ক ভুবনের সূচিপত্র
বিতর্ক ভুবনের সূচিপত্র

 

বিতর্কের মঞ্চবিন্যাস

বিতর্ক-মঞ্চের বিন্যাস কী হবে, এ নিয়ে কোনো বেদবাক্য নেই। বিতর্কের গুরু সক্রেটিস বা ডেমস্থেনেস, কেউই কোনো ছকবাঁধা বিন্যাসে বিতর্ক করতেন না । দার্শনিক সক্রেটিসের প্রতিপক্ষ সব সময় সামনেও দাঁড়িয়ে থাকতেন না। প্রচলিত কোনো বিশ্বাস বা ভাষণের বিরুদ্ধে তিনি কোনো রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে বিতর্ক করতেন। তর্কের খাতিরে তর্ক করার জন্য সফিস্টরাও সমবেত হতেন । সেখানেও কোনো খাঁজকাটা বিন্যাস অনুসরণ করা হতো না। বিন্যাসটা জরুরি বিষয় নয়।

মূলকথা হচ্ছে, কী বলা হলো এবং কীভাবে বলা হলো। তারপরও কথা থাকে। নাটক হচ্ছে জীবনের প্রতিফলন। জীবনের কোনো নির্দিষ্ট ছক নেই। কিন্তু নাট্যমঞ্চের একটা ন্যূনতম ছক থাকে। বিতর্ক যেহেতু একটা শিল্প; অতএব, আমরা চেষ্টা করি এর উপস্থাপন হোক যথাসম্ভব শৈল্পিক। তাই আধুনিক বিতর্ক- মঞ্চেরও একটা বিন্যাস সৃষ্টি হয়ে গেছে।

সাধারণত বিতর্ক-মঞ্চের কেন্দ্রে থাকেন সভাপতি বা পরিচালক। তাঁর দুই পাশে দুই দল। ত্রিমাত্রিক বিতর্ক বা বহুমাত্রিক বিতর্কের ক্ষেত্রে এ বিন্যাস বা প্রণয়ন সুবিধামতো ভাঙা যায়। দ্বিমাত্রিক বিতর্কই অধিক প্রচলিত বলে আমরা আপাতত এর বিন্যাস নিয়েই কথা বলব। পক্ষের দল সভাপতির ডানে এবং বিপক্ষের দল বাঁয়ে বসবে। এর আগে সংসদ, আদালত, বস্তু প্রভৃতি মডেলের মঞ্চবিন্যাসের চিত্র দেওয়া হয়েছে। সেগুলোর একটিকে সুবিধা মতো ব্যবহার করা যেতে পারে মঞ্চ পরিসর ও মিলনায়তনের সুবিধামতো।

ইচ্ছা করলে পক্ষ বা বিপক্ষের আলাদা আলাদা বক্তৃতা-মঞ্চ বাদ দিয়ে কেন্দ্রীয় বক্তৃতা-মঞ্চ ব্যবহার করা যায়। তবে মঞ্চের পাশের দিকে থাকলে সভাপতিকে পেছনে ফেলা হয় না । অর্থাৎ সভাপতি ও দর্শকদের সঙ্গে সমভাবে সংযোগ স্থাপন করা যায়। বিচারকেরা মূল্যায়নের জন্য নিজেদের আসনের অবস্থান বা কেন্দ্রীয় বক্তৃতা-মঞ্চ ব্যবহার করবেন।

সময়সংকেত যদি শ্রবণসম্পন্ন হয়, তাহলে এ আসন সুবিধামতো যেকোনো স্থানে দেওয়া যায়। কিন্তু দর্শন-সংশ্লিষ্ট হলে তাকে কেন্দ্রীয় বলয়েই বসানো উচিত, যেখান থেকে বক্তা এবং বিচারক সহজেই তা অনুসরণ করতে পারেন। অনেক স্থানে দেখা যায়, বিচারকমণ্ডলী সভাপতির পেছনে বসেন। এটা যুক্তিসংগত নয়। কারণ, বিচারক বক্তাকে মুখোমুখি না দেখলে বিচারকাজ পূর্ণাঙ্গ হয় না।

সংসদীয় মডেল বা পুঞ্জ মডেলেও মঞ্চ-বিন্যাস অনুসরণ করা সম্ভব। বক্তাদের সঙ্গে বিচারক এবং দর্শক-শ্রোতাদের শ্রবণ ও দৃষ্টির যোগাযোগ সরাসরি হচ্ছে কি না, তা নিশ্চিত করে বাকি আসনগুলো যেকোনো সৃজনশীল ও সুবিধাজনক বিন্যাসে সাজানো যায়।

বিতর্ক মডেল

যে প্রক্রিয়ায় বিতর্কের পূর্ণ বিষয়টি নিষ্পন্ন হয়, তার একটি প্রতিমান, আদল বা ছাঁচকে বিতর্ক মডেল বলে। যেহেতু বিতর্ক হচ্ছে একটি যোগাযোগের প্রক্রিয়া, অতএব যোগাযোগ মডেলের সাহায্য নিয়েই আমরা বিতর্ক মডেল গড়ে তুলতে পারি।

 

বিতর্কের তত্ত্বীয় দিক
বিতর্কের তত্ত্বীয় দিক

প্রথমে বিতার্কিক একটা বিষয়বস্তু লাভ করেন এবং সিদ্ধান্ত নেন, কোন দিকে বলবেন। পক্ষে-বিপক্ষে বলা পূর্বনির্ধারিত হলে সিদ্ধান্ত পর্বটি অনুপস্থিত থাকে। এরপর বক্তা যথাসম্ভব প্রস্তুতি নিয়ে মঞ্চে তাঁর বক্তব্য উপস্থাপন করেন দর্শক-শ্রোতার উদ্দেশে। উপস্থাপনার উদ্দেশ্য দর্শক-শ্রোতাকে উদ্বুদ্ধ করা। উদ্বুদ্ধকরণ সম্পন্ন হলে দর্শক-শ্রোতার পক্ষ থেকে প্রতিক্রিয়া আসবে।

উদ্বুদ্ধকরণের ওপর নির্ভর করে প্রতিক্রিয়া তিন ধরনের হতে পারে

১. ধনাত্মক প্রতিক্রিয়া (+) :

বিতার্কিকের এটিই প্রত্যাশা। এ ক্ষেত্রে দর্শক- শ্রোতা আনন্দোল্লাস করেন, করতালিতে ফেটে পড়েন ইত্যাদি।

২. ঋণাত্মক প্রতিক্রিয়া (-) :

এটি বিতার্কিকের জন্য দুর্ভাগ্যজনক। এই নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার বহিঃপ্রকাশ নানাবিধ হতে পারে। কথা না শেষ হতেই হাততালি দেওয়া, শিস দেওয়া ইত্যাদি এর লক্ষণ।

৩. নিরপেক্ষ প্রতিক্রিয়া (০):

এটি সাধারণত দুর্লভ। কেননা, দর্শক-শ্রোতা হয় ধনাত্মক কিংবা ঋণাত্মক প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে থাকেন। এর মাঝামাঝি তারা কদাচিৎ অবস্থান করেন। একটা দুঃসহ নীরবতা পালন এর লক্ষণ হতে পারে । তবে বক্তার ক্ষেত্রে দুর্লভ হলেও অধিকাংশ সময়ে সভাপতির ভাষণে এরূপ প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায়।

ধরা যাক, প্রতিক্রিয়া ধনাত্মক হয়েছে, যা বিতার্কিকের মধ্যে দুটো প্রভাব সৃষ্টি করবে একই সঙ্গে। প্রথমত, বিতার্কিকের শক্তি সঞ্চারণ ঘটবে, যা তাঁর উপস্থাপনকে তাৎক্ষণিকভাবে উন্নত করবে। বিশেষ করে যাঁরা সৃজনশীল বা প্রত্যুৎপন্নমতিসম্পন্ন বক্তা, তাঁদের উপস্থাপন যথেষ্ট উন্নত হবে। দ্বিতীয়ত, বিতার্কিক ও দর্শক-শ্রোতার মধ্যে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হবে। বিতার্কিক ধরে ফেলবেন, ‘দর্শক-শ্রোতা আমাকে চায়। বেড়ে যাবে তাঁর আস্থা। দর্শক-শ্রোতাও বিতার্কিকের ওপর আরও নির্ভরশীল হয়ে পড়বেন।

এবার দর্শক-শ্রোতা এবং উদ্বুদ্ধকরণ মিলিয়ে সম্ভব হবে সুনির্দিষ্ট মতপ্রতিষ্ঠা, যা বিতার্কিকের চূড়ান্ত লক্ষ্য। বিচারকও দর্শক-শ্রোতার অন্তর্ভুক্ত। অতএব, বিচারকের মনের মধ্যেও যদি বিতার্কিক মত প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, তাহলে তাঁর বিজয় অনিবার্য। এভাবে একজন বিতার্কিক বিষয়বস্তু পাওয়া থেকে শুরু করে বিজয় অর্জন পর্যন্ত যা কিছু করেন, তা এই মডেলের বিশ্লেষণে দেখানো সম্ভব।

এই মডেলে বিজয় দেখানো হয়নি। ফলাফলে বিজয়ী হওয়া বিতার্কিকের চূড়ান্ত লক্ষ্য নয়, মতপ্রতিষ্ঠাই চূড়ান্ত লক্ষ্য। বিচারক নির্বাচনে ত্রুটি কিংবা বিচারপদ্ধতির জন্য কোনো বক্তা বিজয়ী ঘোষিত না-ও হতে পারেন, এমনকি প্রায় সব দর্শকের আন্তরিক সমর্থন পাওয়ার পরও। তাই এই বিতর্কিত বিষয়টিকে (বিজয়) মডেলের বাইরে রাখা হয়েছে।

উপাদানের আপেক্ষিক গুরুত্ব

এই মডেলের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ‘প্রতিক্রিয়া’। প্রতিক্রিয়া ঋণাত্মক বা শূন্য হলে শক্তিসঞ্চার, যোগাযোগ কিংবা মতপ্রতিষ্ঠাও বিঘ্নিত হবে বা আংশিক হবে। প্রতিক্রিয়ার ধনাত্মকতা নির্ভর করছে সার্থক উদ্বুদ্ধকরণে, যা নির্ভর করছে দর্শক- শ্রোতার সামনে রুচিসম্মত ও যোগ্য উপস্থাপনের ওপর। যোগ্য উপস্থাপন নির্ভর করছে প্রস্তুতি, সিদ্ধান্ত এবং বক্তার নিজস্ব ক্ষমতার ওপর। তার্কিক কীভাবে নিজেকে তৈরি করবেন, তা আমরা ‘বিতর্ক প্রস্তুতির ষড়ভুজ মডেল’ থেকে বিশদ জানতে পারি ।

বিতর্ক মডেলের একেবারে প্রাথমিক উপাদান হচ্ছে বিষয়বস্তু আর চূড়ান্ত উৎপাদন হচ্ছে উদ্বুদ্ধকরণ ও মতপ্রতিষ্ঠা। এই কারখানার কর্মী হচ্ছেন বিতার্কিক। দর্শক-শ্রোতা মূলত ক্রেতা, যেখানে বিক্রেতা বিতার্কিক নিজেই। মডেলের মধ্যবর্তী পর্যায় হচ্ছে প্রস্তুতি এবং মধ্যবর্তী উৎপন্ন হচ্ছে প্রতিক্রিয়া। উপস্থাপনের ক্ষেত্রটি হচ্ছে একটা বাজার, যেখানে বিক্রেতা ও ক্রেতা মুখোমুখি হচ্ছে। উদ্বুদ্ধকরণ হচ্ছে সেই ভারসাম্যের বিক্রয়মূল্য, যা ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়েই প্রত্যাশা করে।

উদ্বুদ্ধকরণের একটি শাখা প্রাথমিকভাবে মতপ্রতিষ্ঠায় সাহায্য করে। তবে সার্থক উদ্বুদ্ধকরণ ধনাত্মক প্রতিক্রিয়া, শক্তি সঞ্চারণ এবং যোগাযোগের মাধ্যমে মতপ্রতিষ্ঠার কাজটিকে আরও শক্তিধর ও সফল করে। মতপ্রতিষ্ঠা একটা আপেক্ষিক বিষয় ।

এই মডেলের চুলচেরা বিশ্লেষণে কারও চোখে অসম্পূর্ণতা ধরা পড়তে পারে। এটা স্বাভাবিক। পৃথিবীর সব মডেল নিয়েই সমালোচনা হয়। আমাদের লক্ষ্য সেখানে নয় । আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে, বিতার্কিক এই মডেলের সাহায্যে সহজেই তাঁর ঘাটতি, দুর্বলতা বা ত্রুটির স্থানটি ধরতে পারবেন এবং সে অনুযায়ী নিজেকে প্রস্তুত করতে পারবেন, নিজেকে উন্নততর করতে পারবেন। প্রায়োগিক উপকারিতা পেলেই তত্ত্ব সার্থক হয় ।

উদ্বুদ্ধকরণ চক্র

বিতর্কের চূড়ান্ত লক্ষ্য মতপ্রতিষ্ঠা হলেও এ কাজটি করতে হয় উদ্বুদ্ধকরণের মধ্য দিয়ে। এ জন্যই বিতর্ক উদ্বুদ্ধকরণের শিল্প। এই উদ্বুদ্ধকরণের প্রক্রিয়াটি আমরা আরেকটু কাছ থেকে দেখতে চাই। তাই দরকার এর বিশ্লেষণ। এই প্রক্রিয়াকে বিশ্লেষণ করলে আমরা যে উদ্বুদ্ধকরণ চক্র লাভ করি, তা নিম্নরূপ

বিতর্কের তত্ত্বীয় দিক
বিতর্কের তত্ত্বীয় দিক

 

অন্যকে উদ্বুদ্ধ করার ইচ্ছা থাকলেও তা সম্ভব নয়, যদি না বক্তা নিজের মধ্যে তাগিদ অনুভব করেন। এ জন্য একই কথা কেউ খণ্ডন করতে পারেন, কেউ পারেন না। আবার এও হতে পারে যেকোনো যুক্তিধারা দুজন বক্তার মধ্যেই সমান তাগিদ সৃষ্টি করেছে। কিন্তু তাঁদের প্রস্তুতি বা আচরণের ভিন্নতার জন্য তাঁদের উপস্থাপন ভিন্ন হলো। কেউ লক্ষ্যে পৌঁছালেন, কেউ পৌঁছালেন না। কেউ পেলেন প্রশান্তি, কেউ পেলেন অশান্তি। অতএব, এই চক্র থেকে বক্তা দুটি শিক্ষা নিতে পারেন ।

১. তাঁর মধ্যে তাগিদ সৃষ্টি হতে হবে। এ জন্য তাঁর তথ্য ও জ্ঞানের পরিধি বাড়াতে হবে। অন্যথায় বিপক্ষ কোনো মিথ্যা যুক্তি, তথ্য বা ধারণা দিলেও তাঁর মধ্যে তা খণ্ডনের তাগিদ সৃষ্টি হবে না। কারণ তাঁর সংকেত-গ্রাহক-যন্ত্র দুর্বল।

২. সেই তাগিদকে সম্বল করে এমন প্রস্তুতি উপস্থাপন (যা আচরণের অন্তর্ভুক্ত)

করতে হবে, যাতে লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়। এখানেই বাচনভঙ্গি, উপস্থাপনা, যুক্তিবোধ—এগুলোর প্রয়োজন বাড়ে। লক্ষ্যে পৌঁছালে এবং দর্শক-শ্রোতারা ধনাত্মক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলে তাঁর প্রশান্তি ও পুলক আসবেই । উদ্বুদ্ধকরণ চক্র ও বিতর্ক মডেলের কার্যকারিতার গভীরে একটা সাদৃশ্য বিদ্যমান। সেটা পাঠক সহজেই ধরতে পারবেন।

যুক্তির কথা

যুক্তি হচ্ছে বিতর্কের প্রাণ। বিতর্কই হচ্ছে যুক্তির যুদ্ধ। বিতর্কের নির্দিষ্ট সময়ে কবিতা, সাহিত্য, নাট্যাংশ, গল্প, তত্ত্ব, তথ্য, বক্তব্য—যা কিছুই উপস্থাপন করা হোক না কেন, এর মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে যুক্তি বিনির্মাণ এবং তার মাধ্যমে উদ্বুদ্ধকরণ-প্রক্রিয়ায় আত্মমত প্রতিষ্ঠা করা। উদ্বুদ্ধকারী বাক্য বা বাক্যাবলির সঞ্চয়নই হচ্ছে যুক্তি।

যুক্তির বৈশিষ্ট্য

যেকোনো ভালো যুক্তির ন্যূনতম ছয়টি বৈশিষ্ট্য রয়েছে

১. নিরাপত্তা (safety):

যে যুক্তি সহজেই খণ্ডনযোগ্য নয়, তার নিরাপত্তা বেশি। অর্থাৎ, বিপক্ষের আক্রমণ চেষ্টা সত্ত্বেও যুক্তিটি নিরাপদ। শেষ বক্তার জন্য যুক্তির নিরাপত্তা বেশি।

২. সাবলীলতা (strength):

অধিক বাস্তবতাসম্পন্ন যুক্তির সাবলীলতা বেশি।

৩. গ্রহণযোগ্যতা (acceptability):

কোনো যুক্তির নিরাপত্তা বা সাবলীলতা থাকলেই যুক্তিদাতার বক্তব্য দর্শক-শ্রোতার দ্বারা গ্রহণযোগ্য হবে, তা নয়। এ ক্ষেত্রে যুক্তিদাতার উচিত দর্শক-শ্রোতার রুচি ও মনস্তত্ত্ব অধ্যয়ন করা।

8. ঐশ্বর্য ( richness):

বিভিন্ন তত্ত্ব, তথ্য, কাব্য, সাহিত্য, রস, শ্লেষ যুক্তির ঐশ্বর্য বাড়ায়।

৫. নৈকট্য (nearness):

যুক্তিসমূহ হাতের কাছের উদাহরণ বা চলমান পৃথিবীর দৈনন্দিন ঘটনার সান্নিধ্যসম্পন্ন হলে তাদের উদ্বুদ্ধকরণ-প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়।

৬. প্রশস্ততা (wideness):

যুক্তিসমূহ এমন প্রশস্ততাসম্পন্ন হওয়া উচিত, যেন এতে অনেক উপাদান ধারণ করা যায়। প্রশস্ত আয়তনের যুক্তিকে খণ্ডন করতেও প্রতিপক্ষ ভয় পায়। কেউ তা খণ্ডন করলেও প্রশস্ত আয়তনের সুবিধার জন্য আবার পাল্টা জবাব দেওয়া যায়।

বিতর্কের রণকৌশল

যে উপায় বা পন্থায় কোনো বিতার্কিক বিপক্ষের মুখোমুখি হয়, তাকে বিপক্ষের রণকৌশল বলে। সাধারণত এই রণকৌশল দুই প্রকারের

ক) রক্ষণাত্মক (defensive)

যখন বক্তা বিষয়বস্তুর নির্ধারিত পক্ষে শুধু নিজের যুক্তি প্রদানেই কৌশল সীমাবদ্ধ রাখে, তখন তাকে রক্ষণাত্মক কৌশল বলে ।

খ) আক্রমণাত্মক (offensive)

যখন কোনো বক্তা আগাগোড়াই অন্যের যুক্তির ওপর আক্রমণ চালায় বা অন্যের যুক্তি খণ্ডন করে যায়, তখন সেই রণনীতিকে আক্রমণাত্মক কৌশল বলে।

সব বিতর্কে শুধু একধরনের রণকৌশল থাকা বাঞ্ছনীয় নয়। আদর্শ বিতর্কে উভয় কৌশলেরই মিশ্রণ রয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে আরেকটি বিতর্কের সূত্রপাত হয়।

১. এক পন্থী বলছেন কৌশলটি হবে প্রথমে রক্ষণাত্মক, পরে আক্রমণাত্মক। সংক্ষেপে কৌশলটিকে বলা যায় ডিএসএফ (Defensive Strategy First)। তাঁদের মতে, প্রথমে যুক্তি প্রদান দিয়ে শুরু করে তারপর খণ্ডন করলে অধিক আকর্ষণীয় হবে।

২. অপর পন্থীর মতে কৌশলটি হবে প্রথমেই আক্রমণাত্মক, অতঃপর রক্ষণাত্মক। সংক্ষেপে কৌশলটিকে বলা যায় ওএসএফ (Offensive Strategy First) । তাঁদের মতে, প্রথমে যুক্তি খণ্ডন দিয়ে শুরু করে বাকি অংশে যুক্তি প্রদান করলে তা বেশি আকর্ষণীয় হবে। বিতর্ক রণনীতির এই বিন্যাস আমরা নিচে দেখতে পাই।

বিতর্কের তত্ত্বীয় দিক
বিতর্কের তত্ত্বীয় দিক

 

আক্রমণ কৌশলের নির্বাচন

ডিএসএফ না ওএসএফ – কোন রণকৌশলটি উত্তম, তা নিয়ে বক্তারা তর্কে অবতীর্ণ হতে পারেন । তবে বিভিন্ন কর্মশালার নিরীক্ষায় দেখা যায়, ওএসএফের পাল্লা ভারী । অর্থাৎ প্রথমে খণ্ডন, তারপর যুক্তি প্রদান। এতে বক্তার সাহস, দাপট প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব প্রকাশিত হয়। প্রথমে এসে ‘প্রদান’ দিয়ে শুরু করলে দর্শক- শ্রোতা ভাবেন, এগুলো তিনি বলবেনই। পক্ষান্তরে প্রথমেই যুক্তি খণ্ডন বা আক্রমণ দিয়ে শুরু করলে প্রতিপক্ষকে দ্রুত ঘাবড়ে দেওয়া যায়, উদ্বুদ্ধকরণ ও সমর্থন দ্রুত বক্তার পক্ষে চলে আসে।

এ ছাড়া ওএসএফ-এর পক্ষে স্মৃতিসংক্রান্ত একটি মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষার সমর্থন মেলে ধরা যাক। আগের বক্তা তিনটি যুক্তি দিয়েছেন কিংবা তার বেশি দিয়েছেন, অথচ দর্শক-শ্রোতার স্মৃতিতে তিনটি ধরা আছে, যা ‘ক’-এর মাধ্যমে দেখানো হলো। এ অবস্থায় বক্তা এসে প্রথমেই নিজের পক্ষে আরও তিনটি যুক্তি দিলেন, যা ‘খ’-এর মাধ্যমে দেখানো হলো। আগের তিনটি আর বর্তমানের তিনটি মিলে মোট ছয়টি যুক্তি দর্শক-শ্রোতাকে তাঁর স্মৃতিতে ধারণ করতে হবে। এতে তাঁর স্মৃতির আয়তন বাড়াতে হবে এবং কষ্টের সঙ্গে এতগুলো যুক্তি ধারণ করতে হবে, যা বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করতে পারে।

বিতর্কের তত্ত্বীয় দিক
বিতর্কের তত্ত্বীয় দিক

 

প্রদানের পালা শেষ করে এবার বক্তা খণ্ডন শুরু করলেন এবং বিপক্ষের তিনটি যুক্তি খণ্ডন করলেন, যা ‘খ’ অংশে দেখানো হলো। চূড়ান্তভাবে দর্শক-শ্রোতার স্মৃতিতে বর্তমান বক্তার তিনটি যুক্তি স্থান লাভ করলেও দর্শক-শ্রোতাকে কষ্ট দেওয়া হলো বেশি।

পক্ষান্তরে, ওএসএফ অনুযায়ী আরও কম ধাপেই এ তিনটি যুক্তি দর্শক- শ্রোতার স্মৃতিতে অনায়াসে স্থান করে নিচ্ছে, যা ৫ম অংশে দেখানো হলো। উপরন্ত দর্শক-শ্রোতাকে C অংশে দেওয়া হচ্ছে স্বস্তি, কেননা A অংশে অবস্থিত আগের বক্তার তিনটি যুক্তিই B অংশে বক্তা এসেই খণ্ডন করে দর্শক-শ্রোতার স্মৃতিকে পরিষ্কার করে স্বস্তি দিচ্ছে। দর্শক-শ্রোতার আর স্মৃতিশক্তির ওপর চাপ বাড়ানোর প্রয়োজন পড়ছে না। C অংশের এই ফাঁক দর্শক-শ্রোতাকে নতুন যুক্তি গ্রহণে উপযোগী বা প্রস্তুত করে তুলছে, যা ডিএসএফ-এ অনুপস্থিত। এক খাবারের ওপর আরেক খাবার না নিয়ে পাকস্থলী পরিষ্কার করে নতুন খাবার নেওয়া স্বাস্থ্যকর।

অতএব, ওএসএফ অনুসরণকারীদেরই আমরা অধিকতর দক্ষ বিতার্কিক হিসেবে বিবেচনা করব।

যুক্তি প্রদানের কৌশল

ধরা যাক, ডিএসএফ এবং ওএসএফ কৌশল দুটির মধ্যে আমরা ওএসএফ মেনে নিয়ে প্রথমে বিপক্ষের যুক্তি খণ্ডন করেছি। এবার যুক্তি প্রদানের পালা। কেউ কেউ বলেছেন, যুক্তি খণ্ডনের সময়েই কিছু যুক্তি প্রদান করা হয়ে গিয়েছে। তা স্বাভাবিক, কিন্তু তারপরও কিছু নতুন যুক্তি থাকতে পারে, যা বিতার্কিক প্রয়োগ করবেন বলে ভেবেছেন।

ধরা যাক, যুক্তি খণ্ডনের পর তার তিনটি নতুন যুক্তি রয়েছে এবং তিনটির মধ্যে একটি সবচেয়ে শক্তিশালী। অপর দুটি প্রায় সমপর্যায়ের কিংবা কোনোটি ২য় শক্তিশালী, কোনোটি ৩য় শক্তিশালী। এ রকম চুলচেরা বিশ্লেষণ একটা উচ্চ ধারণার স্তর সৃষ্টি করে। সে স্তরকে অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য বিফ (Big Idea First-BIF) অনুসারে বড় যুক্তিটি প্রদান করলে উদ্বুদ্ধকরণ-প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে।

বিল (Big Idea Last – BIL) অনুসারে অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী বা দুর্ব যুক্তিটি যুক্তি প্রদানের প্রথমেই প্রদান’ ধারণার স্তরে অকস্মাৎ অধঃপতন ঘটে তা ছাড়া সবচেয়ে ভালো যুক্তিটি যে শেষে বলার জন্য বক্তা রাখবেন, সেটার নিশ্চয়তা কতটুকু? যদি অনুমানের আগেই সময় শেষ হয়ে যায়। বিল এর চেয়ে বরং বিম (Big Idea Model- BIM) কম বিপজ্জনক। তত্ত্ব নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে । কিন্তু অধিকাংশ ভালো বিতর্ক বিশ্লেষণ করলে আগ্রহী বক্তারা দেখবেন যে যুক্তি প্রদানের ক্ষেত্রে বিতার্কিকেরা নিজের মনের অজান্তে হলেও বিফ কৌশল অনুসরণ করেছেন।

বিতর্কের হাতিয়ার এবং উদ্বুদ্ধকরণের হাতিয়ার সমার্থক, কারণ বিতর্কের উদ্দেশ্যই উদ্বুদ্ধকরণ। উদ্বুদ্ধকরণের হাতিয়ার মূলত অনেক সময়েই সম্ভব নয়। তবে সবচেয়ে ভালো লাগা দু-একটা যুক্তি বিতার্কিক নিজেই বের করেন। এই সবচেয়ে ভালো লাগা যুক্তিটিকে আমরা বড় ধারণা বা বিগ আইডিয়া বলতে পারি । প্রশ্ন হচ্ছে, এই বিগ আইডিয়া যুক্তি প্রদানের কোনখানে বসবে। এ থেকে আমরা যুক্তি প্রদানের তিন ধরনের কৌশল পেতে পারি

বিতর্কের তত্ত্বীয় দিক
বিতর্কের তত্ত্বীয় দিক

 

ধরা যাক, পাঁচ মিনিট বিতর্কের প্রথম আড়াই মিনিট বক্তা যুক্তি খণ্ডন করেছেন এবং আড়াই মিনিটে তিনটি নতুন যুক্তি প্রদান করবেন। অবশিষ্ট সবচেয়ে ভালো যুক্তিটি তিনি ইচ্ছা করলে প্রথমে (বিফ), মাঝামাঝি (বিম) বা শেষে (বিল) দিতে পারেন । এ নিয়ে কোনো ধরাবাধা নিয়ম নেই। তবে বিফ বেশি সমর্থনযোগ্য। কারণ, বক্তা প্রথমে ওএসএফ অনুযায়ী যুক্তি খণ্ডন করে বিপক্ষকে নাজেহাল করতে পারেন ।

আবেগের প্রাধান্য ও মোকাবিলার কৌশল

কোনো বিষয়ের সত্যতার ভেতর রয়েছে তিনটি প্রধান উপাদান (১) আবেগ, (২) যুক্তি ও (৩) বাস্তবতা। আবেগের আয়তন প্রাধান্য নিয়ে পরিবেষ্টিত বক্তব্যকে একটা পিরামিডের চিত্রে দেখানো যায়। এখানে একটা পিরামিডের উচ্চতাকে তিন ভাগে ভাগ করে নিচের অংশ আবেগকে দেওয়া হলো। ধরলাম আবেগ-প্রধান বক্তব্য পিরামিডীয় এবং বাস্তবতা প্রধান বক্তব্য উল্টো পিরামিডীয় যা চিত্রে দেখানো হলো।

বিতর্কের তত্ত্বীয় দিক
বিতর্কের তত্ত্বীয় দিক

 

ধরা যাক, একটি বিষয়বস্তু হলো ‘দেশীয় বস্ত্রশিল্পের বিকাশের স্বার্থে বিদেশি বস্ত্র আমদানি নিষিদ্ধ করা উচিত। এর পক্ষে যাঁরা বলবেন, তাঁরা দেশপ্রেমের আবেগকে উদ্বেলিত করতে চাইবেন। চরকা আন্দোলন, দেশি শিল্পের দুরবস্থা, স্বদেশি পণ্যের সেন্টিমেন্ট—কবির সেই বাণী, ‘মায়ের দেয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নেরে ভাই’ প্রভৃতি নানান উপাদানে আবেগকে সঞ্চারিত করবেন তাঁরা সাধ্যমতো। ফলে হাতিয়ার প্রয়োগে অনুসরণ করবেন পিরামিডীয় পদ্ধতি।

বিপক্ষে যিনি বলবেন, তাঁর পক্ষে আবেগ কম, তবে বাস্তবতার সমর্থন বেশি। বাস্তবের আমদানি চিত্র তুলে ধরে তিনি হয়তো বলবেন, দেশের বিদ্যমান সব কটি বস্ত্রকলও মোট দেশজ বস্ত্রের চাহিদা মেটাতে পারে না। আমদানি বন্ধ করলেই যে বস্ত্রশিল্প বিকশিত হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই, বরং চোরাচালান বাড়বে, সরকার শুল্ক থেকে বঞ্চিত হবে। এগুলো বাস্তবতার নিষ্ঠুর চিত্র। 1 বিপক্ষের বক্তাও হয়তো আবেগ সামান্য ব্যবহার করবেন, কিন্তু পক্ষের মতো আবেগকে মুখ্য হাতিয়ারে পরিণত করবেন না।

অর্থনীতি বাস্তবতার হাতিয়ারকে এবং রাজনীতি আবেগের হাতিয়ারকে বেশি খাদ্য জোগায়। মাঝখান থেকে যুক্তি যেকোনো শাস্ত্র থেকে খাদ্য গ্রহণ করে আবেগ ও বাস্তবতার উভয়ের মধ্যে সমন্বয়মূলক সহায়তা দেয় এবং কখনো কখনো যুক্তির খাতিরে যুক্তি হিসেবে নিজেই ফ্যালাসি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিতার্কিক যদি ধরতে পারেন, বিদ্যমান বিষয়বস্তুতে প্রতিপক্ষ উল্টো পিরামিডীয় কৌশল অবলম্বন করবেন, তাহলে তাঁর পক্ষে পিরামিডীয় কৌশল অবলম্বন করাই বিজ্ঞজনোচিত ।

বিতর্ক উপাদানের পারস্পরিক সম্পর্ক

অন্তত কিছুটা সময় আগে প্রাপ্ত বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে যথাসম্ভব প্রস্তুতি সবাই নিতে চায় এবং নেওয়া উচিত। এটাকে অনেকটা বাধ্যতামূলক শিক্ষণ বলা হয়। তাই বলে আবার পুরো পাঁচ মিনিটের বক্তৃতাই মুখস্থ থাকবে-এটাও আমরা চাই না। প্রথম প্রথম বিতার্কিককে কিছুটা মুখস্থও করতে হয়, প্রস্তুতকৃত উপস্থাপনাও রাখতে হয়। অন্যদিকে প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের মাধ্যমে বিতার্কিককে তাৎক্ষণিকভাবেও যুক্তি খণ্ডন করতে হয়। অতএব, আগে প্রাপ্ত বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে যেসব প্রভাবক উপাদানের মুখোমুখি হতে হয় একজন বিতার্কিককে, সেগুলো নিম্নরূপ

১. স্মৃতিকে ধারণ বা মুখস্থ করা (Memorizing), M

২. প্রস্তুতকৃত উপস্থাপন ( Prepared Performance), P

৩. প্রত্যুৎপন্ন সৃজনশীলতা (Spot Creativity), C

৪. তাৎক্ষণিক খণ্ডন (Spot Refutaion), R

স্মৃতিতে ধারণ বা মুখস্থ করা যত বাড়বে, প্রস্তুতকৃত উপাদান তত উন্নত করা সম্ভব। তাদের মধ্যকার সম্পর্ক ধনাত্মক। পক্ষান্তরে প্রত্যুৎপন্নমতির চর্চা যার যত বেশি, তাৎক্ষণিক খণ্ডনের ক্ষমতা তাঁর তত বেশি। তাদের মধ্যকার সম্পর্কও ধনাত্মক। অন্যদিকে মুখস্থ উপস্থাপনের সঙ্গে তাৎক্ষণিক খণ্ডনের সম্পর্ক বিপরীতমুখী। আবার মুখস্থ করার প্রবণতা যার বেশি, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব তাঁর তত কম। তাঁদের সম্পর্ক বিপরীতমুখী। চিত্রাকারে

বিতর্কের তত্ত্বীয় দিক
বিতর্কের তত্ত্বীয় দিক

 

বিতর্কের ভারসাম্য

এই চার ধরনের সম্পর্ককে একটি বাক্সচিত্রে (box diagram) প্রকাশের মাধ্যমে আমরা একজন বিতার্কিকের জন্য মোটামুটি ভারসাম্য অবস্থা নির্দেশ করতে পারি। এখানে মুখস্থশক্তি (M) ও প্রস্তুতি (P) প্রথম মূলবিন্দু 01 ব্যবহার করছে ৷ এদের একটি বাড়লে আরেকটি বাড়ে। তাৎক্ষণিক বুদ্ধি (C) ও খণ্ডন (R) উল্টোদিকের মূলবিন্দু 02 ব্যবহার করছে। বিতার্কিক 0102 এই কৌণিক রেখার ওপর অবস্থান করেন। 01 থেকে 02 এর দিকে গেলে বক্তার মুখস্থ ও প্রস্তুতকৃত পরিবেশনা যত বাড়ে তত কমে যায় তাৎক্ষণিকতা ও খণ্ডনদক্ষতা। এই কৌণিক রেখার মাঝামাঝি E একটা ভারসাম্য বিন্দু। এখানে থাকা ভালো। পারলে বক্তা B বিন্দুর আরেকটু বামে যাবেন। কিন্তু ডানে থাকলে দক্ষতা বাড়বে না।

বক্তার অনুক্রম ও খণ্ডনের বণ্টন

তার্কিকের বক্তব্য তৈরি কথা ও খণ্ডন কথার মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে যায়। এই বণ্টন নির্ভর করে বক্তার অবস্থানের ওপর। বিষয়বস্তুর পক্ষে বলা একটি দলের বক্তব্য বণ্টনে প্রথম বক্তার খণ্ডন কথা নেই বা খুব কম। আর দলপতির জন্য তা সবচেয়ে বেশি, যা চিত্রের মাধ্যমে দেখানো যায়

বিতর্কের তত্ত্বীয় দিক
বিতর্কের তত্ত্বীয় দিক

 

তবে প্রথম বক্তা আমন্ত্রিত বা অনুমিত খণ্ডন করতে পারেন এই বলে যে বিপক্ষ হয়তো বলবেন । এতে প্রথম বক্তার খণ্ডন দক্ষতা বাড়ে এবং বিপক্ষের বক্তারা বিপাকে পড়েন ।

আরোহ বনাম অবরোহ পদ্ধতি

যুক্তিশাস্ত্রে এ দুই পদ্ধতি বিশেষ আলোচিত। কোনো যুক্তি প্রমাণে আমরা অনেক সময় অজ্ঞাতসারেই হয় আরোহ অথবা অবরোহ পদ্ধতি অবলম্বন করি। চিত্রাকারে

 

বিতর্কের তত্ত্বীয় দিক
বিতর্কের তত্ত্বীয় দিক

 

উদাহরণস্বরূপ

১. সকল মানুষ মরণশীল, অতএব ম্যারাডোনাও মরবেন—অবরোহ ।

২. আইনস্টাইন মরেছেন, নজরুল মরেছেন, মরেছেন রবীন্দ্রনাথও। অতএব সকল মানুষ মরণশীল আরোহ। কতগুলো বিশেষ সিদ্ধান্ত থেকে সাধারণ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া।

বিতার্কিক যুক্তির বিন্যাসের ব্যাপারে ঠিক কোন পদ্ধতি অবলম্বন করবেন, সেটার কোনো কঠিন নিয়ম নেই। যে বিষয়ে আইন বা সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থিত বিধান, মনস্তাত্ত্বিক প্রমাণ এবং বিজ্ঞানের সমর্থন রয়েছে, সে ক্ষেত্রে অবরোহ পদ্ধতি বেশি কার্যকর। কারণ, এ ক্ষেত্রে আমরা সেই সাধারণ সিদ্ধান্তটির কথা বলে তারপর বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে আসতে পারি। এটা বিশ্বস্বীকৃত যে, শিক্ষা বৃদ্ধি মানেই দারিদ্র্যের ক্ষয়—এটা বলে আমরা বিশেষ কোনো দেশ বা অঞ্চলের কথায় আসতে পারি। তখন পদ্ধতিটি অবরোহী এবং নিঃসন্দেহে বেশি উদ্বুদ্ধকারী। এর বিপরীত পরিস্থিতিতে স্বভাবতই আরোহী পদ্ধতি বেশি কার্যকর।

বিতর্কে যুক্তির সংখ্যা

অনেকে ভাবতে পারেন, বেশিসংখ্যক যুক্তি দিলেই বেশি নম্বর উঠতে থাকবে বা দর্শক-শ্রোতা বেশি উদ্বুদ্ধ হবেন। এ ধারণা সর্বাংশে ঠিক নয়। যুক্তির সংখ্যা বাড়তে থাকলে নম্বর বাড়ে। কিন্তু প্রায় সব ক্ষেত্রেই তা ক্রমহ্রাসমান হারে বাড়ে। চিত্রাকারে

বিতর্কের তত্ত্বীয় দিক
বিতর্কের তত্ত্বীয় দিক

 

যুক্তির সংখ্যা বরং কিছু কমিয়ে ভিত্তি ও বিশ্লেষণ শক্ত করলে দর্শক-শ্রোতা বেশি উদ্বুদ্ধ হবেন। তবে বিতর্কের সময় পাঁচ মিনিট না হয়ে যদি তার চেয়ে বেশি হয়, তাহলে অবশ্য অধিক যুক্তির সমাবেশ ঘটানো সম্ভব। কিন্তু তারপরও আপত্তি থেকে যায়। পৃথিবীতে যত বড় বড় উদ্বুদ্ধকারী ঘটনা ঘটেছে, তার পেছনে কখনোই অজস্র যুক্তির সংখ্যাধিক্য ছিল না। দু-একটা ভালো যুক্তিই মনকে নাড়া দেয় বেশি। আসলে যুক্তি দুর্বল হলেই বেশি সংখ্যায় সমাবেশ করার প্রয়োজন বাড়ে।

সমাপনী

কে কোন কৌশল বা পদ্ধতি ব্যবহার করবেন, এটা বক্তার নিজস্ব পছন্দের ব্যাপার। তবে তত্ত্বীয় বিশ্লেষণে এই শাস্ত্রকে দেখলে তর্কযুদ্ধের ক্ষমতা বাড়ে। দক্ষ তার্কিকের জন্যে এ কৌশলগুলো পরবর্তী সময়ে আর মনে রাখার প্রয়োজন পড়ে না। তিনি মনের অজান্তেই হয়ে ওঠেন তাত্ত্বিক তর্কবিদ।

Leave a Comment