আজকের আলোচনার বিষয়ঃ বিতর্কের আদালত মডেল

বিতর্কের আদালত মডেল
আইনি কাঠামোতে তর্ক লড়াই
এই গ্রন্থের ‘বিতর্কের প্রধান তিন ধারা’ শীর্ষক নিবন্ধে বিতর্কের শ্রেণিবিভাগ করা হয়েছে। বিতর্ক একটি বিকাশশীল শাস্ত্র। সুতরাং এর শ্রেণিবিভাগের দৃষ্টিভঙ্গিতেও পরিবর্তন আনতে পারেন যে কেউ। তবে এর উপস্থাপনাগত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সব বিতর্ককে প্রধানত তিনটি ভাগেই ফেলা যায়—প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ ও বিবিধ।
আজ বিতর্কের বেশ কিছু ধারাই আমাদের কাছে পরিচিত হতে চলেছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ১. সনাতনী বিতর্ক, ২ সংসদীয় বিতর্ক, ৩, জাতিসংঘ মডেল, ৪. পুঞ্জ বিতর্ক, ৫ ত্রিমাত্রিক বিতর্ক, ৬. বারোয়ারি বিতর্ক, ৭. প্রাক-নির্বাচনী বিতর্ক, ৮ বহু বিতর্ক, ৯. কাবা বিতর্ক, ১০. আদালত মডেল, ১১. নাট্য বিতর্ক ও ১২. একক বিতর্ক ইত্যাদি।
এগুলোর অধিকাংশ ধারা সম্বন্ধে আমরা কমবেশি পরিচিত বা লেখার মাধ্যমে অবগত। বাকি কয়েকটি ধারার ওপর আলোকপাত করা হয়েছে সামান্যই। এ লেখায় আদালত মডেল (Court Model) উপস্থাপন করলাম। আলোচনা ও চর্চার মাধ্যমে এ মডেলের কিছু সুবিধা-অসুবিধা স্পষ্ট হয়ে উঠবে, যা থেকে নিয়মকানুনের সৃজনশীল পরিবর্তন, পরিবর্ধন সম্ভব।
আদালত বিতর্কের কথারম্ভ
এটি বিতর্কের প্রতীকী উপস্থাপনা। আদালতে দুই পক্ষের উকিল বা অ্যাডভোকেটের মধ্যে কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে যে বাগযুদ্ধ সংঘটিত হয়, তারই নিয়ন্ত্রিত শিল্পরূপের নাম বিতর্কের আদালত মডেল। ১৯৯৪ সালের জুন মাসে সেন্ট জোসেফ হাইস্কুলের আয়োজনে যে স্কুল-বিতর্ক কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়, সেখানে এই মডেল প্রথমবারের মতো পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করা হয়।
একটি আদালতে দক্ষ আইনি লড়াই আমাদের আন্দোলিত করে। সে রকম মেজাজের আবহ সৃষ্টি হয় আদালত মডেলে।
আদালত বিতর্কের মঞ্চবিন্যাস
এটির মঞ্চগত বিন্যাস কী হবে, তা মূলত আদালতই বলে দেবেন। তবে বিতর্কের স্বার্থে আমরা বাংলা বর্জন করেছি। এ মঞ্চগত বিন্যাস হতে পারে নিম্নরূপ

সাধারণ নিয়মাবলি
১. এ বিতর্কে বাদী ও বিবাদী দুটো পক্ষ থাকবে।
২. বাদীপক্ষ কোনো নির্দিষ্ট ইস্যুতে আদালতে মামলা করবে।
৩. বিচারক বা বিচারপতি এ বিতর্ক পরিচালনা করবেন।
৪. উভয় পক্ষের বাদী-বিবাদী কাঠগড়ায় দাঁড়াবেন।
৫ উভয় পক্ষে সাধারণত তিনজন করে কৌসুলি বা ব্যারিস্টার থাকবেন ।
৬. কৌসুলিরা বিরুদ্ধপক্ষের কাঠগড়ায় দাঁড়ানো ব্যক্তিকে জেরা করতে পারবেন । তবে এই জেরা কখনোই টানা দুই মিনিটের বেশি হবে না।
৭. বিচারপতির আসনের সামনে বসবেন ‘প্যানেল জুরি, যাঁরা বিতর্কের বিচারক হিসেবে বিবেচিত হবেন। তাদের রায়ই সবশেষে বিচারপতি ঘোষণা করবেন।
৮ সংসদীয় বিতর্কের পয়েন্ট অব অর্ডার’-এর মতো অন্য পক্ষের কৌসুলিরআপত্তিকর মন্তব্যের জন্য ‘অবজেকশন ইয়োর অনার’ উত্থাপন করা যাবে।
৯. বক্তব্য প্রদানের সময় কৌসুলির আদালতযোগ্য হাঁটাচলা অনুমোদনযোগ্য।
১০. বিচারপতি ইচ্ছা করলে কৌসুলির জেরা বা বক্তব্য মাঝপথে থামিয়ে দিতে পারেন। বক্তব্য বা জেরা ভিন্ন খাতে চলে গেলে কিংবা আদালতের পবিত্রতা নষ্ট হওয়ার উপক্রম হলে বিচারপতি এই ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন। এটি চ্যালেঞ্জ করা যাবে না।
১১. জেরা ও বক্তব্য শেষে চূড়ান্ত যুক্তি প্রদর্শন করে বিচারপতি রায় ঘোষণা করবেন। এই চূড়ান্ত যুক্তি প্রদর্শন তাঁর ঐচ্ছিক ব্যাপার।
১২. বিতর্কের শুরুতে বিচারপতি সব মামলা সম্বন্ধে পূর্বভাষণ দেবেন।
১৩. আইনের সব ধারার নম্বর জানা বিতার্কিকের পক্ষে সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে আইনের মূলভাব নষ্ট না করে একটা কৃত্রিম ধারা উল্লেখ করা যাবে। তবে রাষ্ট্রীয় সংবিধান ও জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার আইনের ধারার সঠিক নম্বর বলতে হবে।

১৪. প্রথমে কাঠগড়ায় উঠেই বাদী ও বিবাদীরা প্রথানুসারে ‘যাহা বলিব সত্য বলিব’ বাক্যাবলি উচ্চারণের মাধ্যমে শপথ পাঠ করবেন।
১৫. অতিরিক্ত কোনো সাক্ষীকে বক্তব্য রাখতে দিলে সময়ের সীমাবদ্ধতা ও শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হতে পারে বলে এটি সংযোজন না করাই বাঞ্ছনীয়। তবে উভয় পক্ষই প্রামাণ্য বস্তু জুরির টেবিলে উপস্থাপন করতে পারবে।
১৬. সম্বোধন হবে ‘মহামান্য আদালত’ বা ‘ইয়োর অনার’ জাতীয় শব্দাবলির মাধ্যমে। বিপক্ষের বন্ধু কখনোই বলা যাবে না। বলতে হবে বিপক্ষের বিজ্ঞ ব্যারিস্টার বা সম্মানিত কৌসুলি।
১৭. কৌসুলি তাঁর বক্তব্যের যেকোনো এক স্থানে জেরা করবেন বাদী বা বিবাদীকে। কিন্তু তার আগে আদালতের অনুমতি নিতে হবে।
১৮. শৃঙ্খলা বজায় ও গুঞ্জন দমনের লক্ষ্যে বিচারপতি যেকোনো সময় ‘অর্ডার’ প্রয়োগ করতে পারেন ।
১৯. বিবাদী বেকসুর খালাস মানে বিপক্ষ বিজয়ী। এ ক্ষেত্রে বাদীর কোনো শান্তি হবে না। তবে বিবাদী শাস্তি পেলে বিচারপতি রায়ে তা উল্লেখ করবেন এবং তাঁকে কারাগারে প্রেরণের জন্য নিরাপত্তাকর্মীকে নির্দেশ দেবেন ।
২০. ধারাবাহিকভাবে সবার বক্তব্য শেষ হওয়ার পর যথাক্রমে বাদী ও বিবাদীপক্ষের প্রধান কৌসুলিদের প্রত্যেকে তিন মিনিট করে যুক্তিখণ্ডনের সুযোগ পাবেন । এ ক্ষেত্রে কোনো নতুন যুক্তি উত্থাপিত হবে না।
২১. এই অভিযোগ খণ্ডন শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নম্বর যোগ শুরু হবে। এই সময়ের ভরাটকারী হিসেবে বিচারপতি বাদী ও বিবাদীকে দুই থেকে তিন মিনিট করে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে পারেন। এই সম কৌসুলিদের পক্ষ থেকে কোনো আপত্তি উত্থাপন করা যাবে না। তবে প্রয়োজন মনে করলে বিচারপতি যে কারও বক্তব্য থামিয়ে দিতে পারেন বা রুলিং দিতে পারেন।
২২. যেকোনো রুলিং অগ্রাহ্য করে বক্তব্য দিলে বিচারপতি যে কাউকে আদালত অবমাননার দায়ে আদালত থেকে বহিষ্কার করে দিতে পারেন। তার এই বহিষ্কারাদেশ চ্যালেঞ্জ করা যাবে না।
২৩. বিচারপতি প্রথমে সতর্কতামূলক উপদেশ বা হলুদ কার্ড এবং একাধিকবার বিশৃঙ্খলার জন্য চূড়ান্ত বহিষ্কারাদেশ বা লাল কার্ড দেখাতে পারেন।
২৪. বিতর্ক-মধ্যবর্তী কোনো উত্থাপিত আপত্তির পক্ষে বা বিপক্ষে আইনগত ব্যাখ্যাদানের প্রয়োজন হলে বিচারপতি জুরিদের সাহায্য নিতে পারেন বা সিদ্ধান্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ জুরিদের ওপর ছেড়ে দিতে পারেন।
২৫. জুরিদের সংখ্যা বিজোড় হবে। ন্যূনতম সংখ্যা ৩।
২৬. জুরিরা নম্বর দেবেন। কিন্তু নম্বরের ভিত্তিতে বিজয়ী ঘোষিত হবেন না। প্রত্যেক জুরি বানী বা বিবাদীকে জয়ী ঘোষণা করবেন এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থনের ভিত্তিতে চূড়ান্ত রায় ঘোষিত হবে প্রধান বিচারপতির কণ্ঠে দশটি বিজয়ী দলের মধ্যে যদি আটটিকে কোয়ার্টার ফাইনালে তুলতে হয়, তখন নম্বরের বিবেচনা আবশ্যক।
২৭. কাঠগড়ায় দণ্ডায়মান বাদী ও বিবাদী তাঁদের উত্তরদানের ক্ষমতা, যথার্থতা, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, তাৎক্ষণিক বুদ্ধি, সৌজন্য ও সামগ্রিক ভাবমূর্তির জন্য প্রত্যেক জুরির কাছ থেকে ২৫ বা ১০-এর মধ্যে নম্বর পাবেন। তবে এটি দলীয় নম্বরের সঙ্গে যুক্ত হবে। কখনোই শ্রেষ্ঠ বক্তা ঘোষণায় তা যুক্ত হবে না।
২৮. সাধারণত কোনো পক্ষের শেষ কৌসুলিকে প্রধান কৌসুলি করা যায়। তবে আদালতের প্রধান কৌসুলিরা প্রথম দিকেই কথা বলেন, এতে আদালত চাঙা হয়ে ওঠে। মোটামুটি ভারসাম্য রাখার স্বার্থে আমরা ২য় কৌসুলিকে প্রধান কৌসুলির মর্যাদা দিতে পারি।
২৯. বিচারপতি চূড়ান্ত রায় না দেওয়া পর্যন্ত আদালত মুলতবি ঘোষণা করতে পারবেন না।
৩০. প্রত্যেক কৌসুলি অন্যান্য বিতার্কিকের মতো যে বিষয়ে নম্বর পাওয়া প্রয়োজন, তা পাবেন। তবে তার জেরা করার দক্ষতার ওপর একটা সামগ্রিক নম্বর থাকবে। হতে পারে এটি ১০। জুরিরা তাঁর জেরা করার শৈলী, দক্ষতা, বুদ্ধি প্রভৃতি বিবেচনা করে এ ক্ষেত্রে নম্বর দেবেন। এ ক্ষেত্রে আমরা সাধারণভাবে নিচের উপায়ে নম্বরপত্র সাজাতে পারি:
| ক্ষেত্রবক্তা | উপস্থাপনা ও বাচনভঙ্গি | উচ্চারণ | যুক্তিপ্রদান ও খণ্ডন | তত্ত্ব ও তথ্য | জেরা | সামগ্রিক | মোট | মন্তব্য অবস্থান |
৫ | ৫ | ১০ | ৫ | ১০ | ১০ | ৪৫ | ||
| ১ম কৌসুলি | ||||||||
| ২য় কৌসুলি | ||||||||
| ৩য় কৌসুলি | ||||||||
| বাদীর জেরার নম্বর | ||||||||
| খণ্ডনপর্বে প্রধান কৌসুলির নম্বর | ||||||||
| মোট দলীয় নম্বর | ||||||||
বিতর্ক-ক্ষমতা ও অনুষ্ঠানের আকর্ষণ বৃদ্ধির লক্ষ্যে আইন-চেতনা ও আদালতের দিকে নজর রেখে উত্তরণমুখী প্রয়োজন সাপেক্ষে আরও নিয়ম সংযোজন করা সম্ভব। তবে আদালতের চেয়েও সতর্কদৃষ্টি থাকবে বিতর্কের দিকে।

দৃষ্টান্তে আদালত মডেল
একজন সচেতন নাগরিক আদালতে মামলা করলেন, কোচিং সেন্টারের বাণিজ্য বন্ধ করা হোক’। সেই নাগরিক হলেন বাদী। বিবাদী কোচিং সেন্টার সমিতির সভাপতি। তাঁরা দুজনেই বাদী ও বিবাদীর কাঠগড়ায় দাঁড়ালেন। প্রত্যেকের পক্ষে রয়েছেন তিনজন করে উকিল, ব্যারিস্টার বা কৌসুলি, অনেকটা তিনজন বক্তার অনুক্রমে। প্রত্যেকে জেরাসহ বক্তব্য রাখার সুযোগ পাচ্ছেন পাঁচ মিনিট করে। তবে জেরা একজন দুই মিনিটের বেশি করতে পারবেন না।
এ ক্ষেত্রে বাদী-বিবাদীর কাঠগড়ায় যাঁরা আছেন, তাঁদেরও সতর্ক বক্তা হওয়া প্রয়োজন। তা না হলে বিরোধীপক্ষের কৌসুলি জেরা করে ঘাবড়ে বা ফাঁসিয়ে দিতে পারেন। বাদীপক্ষের কৌসুলি বক্তব্য রাখার পর বিবাদীপক্ষের প্রথম কৌসুলি এই সনাতনী তর্কের ধারাক্রমে অংশ নিচ্ছেন। বিচারপতির ইচ্ছায় এবার কাঠগড়ায় দণ্ডায়মান দুজনের বক্তব্য থাকতে পারে । তারপর রায় ।
আদালত মডেলের এই বিতর্কের মধ্যে একটা উদ্দীপনা কাজ করে। পেশা হিসেবে যাঁরা আইনকে নিতে চান কিংবা আইন ও যুক্তি-সম্পর্কিত চেতনা বাড়াতে চান, তাঁদের জন্য এ মডেলের চর্চা নিঃসন্দেহে ফলোৎপাদক। এ মডেলের উত্তরণে আইনজ্ঞ, আইনের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের উপদেশ ও পরামর্শ সাদরে গৃহীত হবে। তবে সবকিছুর মূল লক্ষ্য বিতর্কচর্চার উৎকর্ষ সাধন। এ লক্ষ্যেই নিত্য জীবনের বিভিন্ন মডেলের আশ্রয়ে বিতর্ককে অঙ্গীভূত করা হচ্ছে। চেতনা ও নান্দনিকতা—এ উভয়ের সম্প্রসারণেই বিতর্ক নিবেদিত ।
