আজকে আমরা আলোচনা করবো টেলিভিশন বিতর্কের সংকট ও উত্তরণপন্থা

টেলিভিশন বিতর্কের সংকট ও উত্তরণপন্থা
বাংলাদেশ টেলিভিশন বিতর্ককে জনপ্রিয় করেছে, অন্যদিকে আমাদের সময়ে আশি ও নব্বইয়ের দশকে নানাভাবে বিতর্কিতও হয়েছে। এ লেখাটি তারই প্রতিফলন। এর কিছু বিষয় এখন শোধিত করা হলেও অনেক কথা সরকারি মালিকানাধীন অথবা সরকার প্রভাবিত গণমাধ্যমের জন্যে আজও প্রাসঙ্গিক। টিভি বিতর্ক ব্যবস্থাপনা বা কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিভঙ্গির অভাবে বন্ধ রয়েছে। এটি চালু হলে নিচের কথাগুলো আবার প্রযোজ্য হবে যা আমি বলেছিলাম নব্বইয়ের দশকে।
দীর্ঘ সময়ে পৃথিবীর সবকিছুতেই পরিবর্তন ঘটে, ডারউইনবাদে প্রাণীরও পরিবর্তন ঘটে, জাগতিক প্রবাহে চিন্তা-চেতনায় পরিবর্তন ঘটে। কিন্তু স্থবির হয়ে থাকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের বিতর্ক অনুষ্ঠান — অনেকটা রেলওয়ের খাদ্যতালিকার মতো। তার কারণ, বিটিভির বিতর্ক বিভাগ কোনো সমালোচনা গ্রহণ করে না । মান উন্নয়ন প্রয়োগ করে না। সহজ কথায়, কোনো সমালোচনাই সহ্য করে না, হিটলারের মতো। বরং, সমালোচককে প্রত্যাখ্যান করে মুসোলিনির মতো। মাথার ওপর বিটিভি প্রশাসন বসে থাকে, পরমত অসহিষ্ণু হয়ে সমালোচককে চিহ্নিত করে, বিটিভিতে তার দ্বার রুদ্ধ করে প্রয়োজনে নিয়োজিত হয় বিতাড়নের আরাধ্য সাধনায়।
মাননীয় তথ্যমন্ত্রী বলছেন, বিটিভিতে অহোরাত্রি গণতন্ত্রের উৎসব হচ্ছে। অথচ আজ পর্যন্ত কোনো একটি গণতান্ত্রিক বা মুক্ত রাজনৈতিক বিষয়বস্তুর ওপর বিতর্ক হলো না। মেধাবী বক্তারা যদি-বা যুক্তির অবলম্বনে দু-একটি বাস্তব রাজনৈতিক দৃষ্টান্ত তুলেছেন তো মরেছেন। পারলে পাঁচ মিনিটের বক্তৃতার চার মিনিটই ছেঁটে ফেলা হয়। টিভির দর্শকেরা বুঝতেই পারেন না, কীভাবে এই এক মিনিটেই বক্তা ‘শ্রেষ্ঠ বক্তা হলেন। অধিকাংশ দর্শক-শ্রোতাই এ ‘গণতান্ত্রিক’ ছাঁটাছাটির ব্যাপারটা ধরতে পারেন না। তাঁদের মধ্যে সৃষ্টি হয় বিতর্ক সম্বন্ধে অবিশ্বাস কিংবা ভ্রান্ত ধারণা।
রানি এলিজাবেথকে উদ্দেশ করে ইদি আমিনের এক রম্য উক্তি, যা প্রায় সবারই জানা, প্রকাশিত হয়েছে জাতীয়, আন্তর্জাতিক অসংখ্য পত্রিকায়। সে উক্তিকে ডালপালাসহ কেটে ফেলে বিটিভি মনে হয় রানি এলিজাবেথ এবং ইদি আমিন উভয়কেই বাচিয়ে দিয়েছে। মাত্র কিছুদিন আগে পর্যটন-সংক্রান্ত বিতর্কে এক বক্তার আমলাতন্ত্রের সমালোচনাকারী অংশগুলো কেটে দেওয়া হলো শ্রীজ্ঞানহীন বর্বর নাপিতের মতো।

অথচ কথাগুলো তিনি নিছক আমলাতন্ত্রের সমালোচনার তাগিদে করেননি, করেছেন পর্যটনশিল্পের শ্রীবৃদ্ধির স্বার্থে, বৃহত্তর জনস্বার্থে। প্রচারিত হলে দেশের উপকারই হতো। কথায় বলে, টেলিভিশন দলীয় স্বার্থে কাজ করে। এটা ঠিক নয়। স্থবির আমলাতন্ত্রকে সমালোচনা করলে দলীয় স্বার্থের কোথায় আঘাত লাগে, তা আমাদের বোধগম্য নয়। স্থবির আমলাতন্ত্র সব দলেরই অগ্রগতির প্রতিবন্ধক।
সত্যিই রহস্যময় বাক্স টেলিভিশন। বুঝে না বুঝে, কখনো-বা মজ্জাগত ‘প্রভুসন্তুষ্টি’ প্রবৃত্তি থেকে কখন যে কার স্বার্থ রাখতে গিয়ে অন্য কারোটা রেখে ফেলে, তা ধরাই দুঃসাধ্য। তবে অধিকাংশ সময়ই যে এর শ্রীজ্ঞানহীন সেন্সর প্রথা গণস্বার্থের বিরুদ্ধে যায়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
শান্তিবাহিনী, ইদি আমিন, রানি এলিজাবেথ কিংবা স্থবির আমলাতন্ত্র – এ-জাতীয় অসংখ্য দৃষ্টান্তের সমাবেশে যে সত্যটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তা হলো টেলিভিশন বিতর্কে সেন্সর প্রথা সম্পূর্ণ উচ্ছেদ করা উচিত। সরাসরি সম্প্রচারিত ‘অভিমত’ কিংবা রাজনৈতিক মতবিনিময়মূলক ‘মুখোমুখি’ অনুষ্ঠানে কোনো সেন্সর না থাকলে টেলিভিশন বিতর্কে তা থাকবে কেন? সেখানে সেন্সর না থাকলে কি জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে? নাকি স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েদের কথা শুনে সমস্ত জাতি খেপে উঠে সরকারকে তাড়িয়ে দেবে? নাকি তাদের কথায় উদ্বুদ্ধ হয়ে হঠাৎ কোনো বহিঃশত্রু বাংলাদেশকে আক্রমণ করে বসবে?
যেহেতু ব্যাপারটি দলীয় মন্ত্রীবর্গ বা তোষামুদে বক্তাদের সমন্বয়ে কোনো স্তুতিমূলক আলোচনা অনুষ্ঠান নয়, যেহেতু ব্যাপারটি বিতর্ক, সেহেতু এখানে পক্ষে-বিপক্ষে বলার স্বাধীনতা দিতেই হবে—কেউ কোনো অসংগত কথা বললে বিপক্ষ এসে তা খণ্ডন করবে। উভয় পক্ষের কথা শোনার জন্যই এই বিতর্ক, যার প্রাণ হচ্ছে দ্বন্দ্ব, কোনো একপেশে স্তুতি নয় ।
বিটিভি সরকারি স্তুতিমূলক কথাবার্তায় কোনো সেন্সর করবে না, অথচ বিষয়বস্তুর স্বার্থেও যদি বিপক্ষ সরকারের কোনো সমালোচনা করে, সেখানে জন্মাদের মতো চাপাতি চালাবে। এটা তো কোনো বিবেকবান মানুষ মেনে নিতে দিন অথবা বিতর্ক অনুষ্ঠানকে ‘জাতীয় টেলিভিশন সরকারি গুণকীর্তন পারেন না। তার চেয়ে জেনারেল এরশাদের সরকারের মতো বিতর্ক বন্ধ করে। প্রতিযোগিতা’ নাম দিয়ে প্রচার শুরু করুন।

টিভি বিতর্কে বিষয়বস্তুর মান বনেদি বাড়ির হালখাতার মতো। কোনো পরিবর্তন নেই। ষাট বা সত্তরের দশকের বিতর্ক বিষয়বস্তু যথা বিজ্ঞান অভিশাপ না আশীর্বাদ, গ্রাম ভালো না শহর ভালো, সন্তানের শিক্ষায় বাবার দায়িত্ব বেশি না মায়ের দায়িত্ব বেশি, কৃষি ভালো না শিল্প ভালো, জনসংখ্যা না অশিক্ষা—কোনটি বড় সমস্যা, ধনী ভালো না গরিব ভালো, পরিবার পরিকল্পনা না অধিক খাদ্য উৎপাদন—ইত্যাকার ভাব নিয়ে আজও বিতর্ক হচ্ছে। এর মধ্যে পুনরাবৃত্তি আর চর্বিতচর্বণের বাতিক বেশি।
বিষয়বস্তুগুলো কোনো বার্তা বা সুস্থ শিক্ষা দিচ্ছে না। যেটুকু দিচ্ছে, সেটাও আবর্তিত হচ্ছে মান্ধাতার যুগকে ঘিরে। আধুনিক সমস্যা, অসংখ্য জীবনবোধ, নবতর রাজনৈতিক চিন্তা, সামাজিক দর্শন, প্রগতিশীল মতাদর্শ বিষয়বস্তুতে অনুপস্থিত। বিশেষত সরকারি গণমাধ্যমে বিতর্কশিল্পের অনগ্রসরতার প্রধান কারণগুলো নিম্নরূপ
১. বিতর্কে সেন্সর প্রথা :
সেন্সর প্রথার উৎপাতে নতুন নতুন প্রগতিশীল বিষয়বস্তু আসতে পারছে না। দু-একটা এলে সেন্সর কসাইদের অত্যাচারে তা আত্মহত্যা করছে।
২. বিষয়বস্তু আহ্বানের অনুপস্থিতি :
প্রতিযোগিতামূলকভাবে বিষয়বস্তু আহ্বান করলে এর মান উন্নত করা সম্ভব। এতে কোনো বাধা থাকার কথা নেই। একটা বাধা, সেটা হচ্ছে বিতর্ক বিভাগের গুণগ্রাহিতার অভাব। তারা যদি ভাবে, শ্রেষ্ঠ বিষয়বস্তুগুলো শুধু তাদের মগজ থেকেই বেরোবে, সে বিষয়বস্তুগুলোর দ্বন্দ্বক্ষমতা, সমকালীনতা, শিক্ষা-সম্পৃক্ততা এবং ভারসাম্য হবে অনুপম, তাহলে কিছু বলার নেই। শুধু ভাবার আছে- বোকারও স্বর্গ থাকে ।
যত দূর জানা যায়, বাইরে থেকে প্রতিযোগিতামূলকভাবে বিষয়বস্তু আহ্বানের এবং তাদের যোগ্যতা যাচাইয়ের জন্য গবেষক নিয়োগের ব্যবস্থা রয়েছে বিতর্ক বিভাগের মূল নীতিমালায়, কিন্তু তা আজ কার্যকর নয় কেন? কোনো ব্যক্তি বা সাহিত্যগোষ্ঠী কিংবা কোনো বিতর্ক সংঘ যদি যোগ্য বিষয়বস্তু প্রদান করে, তাহলে সেই প্রদায়কের কথা স্বীকার করে তাদের জন্য ন্যূনতম সম্মানী দিয়ে টিভি বিতর্ক বিভাগ কি ন্যূনতম সৌজন্যের পরিচয় দিতে পারে না? এতে বাইরের অংশগ্রহণ বাড়ে এবং বিষয়বস্তুর মান উন্নত হয়।
৩. গতানুগতিক বিতর্কপদ্ধতি :
এই গতানুগতিক সীমাবদ্ধ পদ্ধতিতে সৃজনশীল আকর্ষণীয় বিষয়বস্তু কাঙ্ক্ষিত হারে বেরিয়ে আসতে পারে না।
টেলিভিশন বিতর্ক বিভাগে যাঁরা চাকরি করছেন, অর্থাৎ জনাব প্রযোজক থেকে সবাই যে দেশের এককালের সেরা বিতার্কিক, তা কিন্তু নয়; এবং সেটা যে হতেই হবে তা আমরা প্রত্যাশা করি না। কারণ, এটা হচ্ছে একটা সাংস্কৃতিক আমলাতন্ত্রের ব্যাপার। ঠিক যেমন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব থেকে পিয়ন পর্যন্ত সবাই কবি, সাহিত্যিক, গায়ক বা নৃত্যশিল্পী নন। কিন্তু তাঁদের কাজ হচ্ছে সমন্বয় করা। টিভি বিতর্ক বিভাগের সেই সমন্বয়ে নমনীয়তা নেই, নেই গুণগ্রাহিতার বস্তনিষ্ঠ মাপকাঠি।
বিতর্ক বিভাগ দেশের প্রথামতো বিতার্কিক, বিতর্ক বিচারক, বিতর্ক-চিন্তকদের সঙ্গে মতামত বিনিময় করতে পারে—কীভাবে এর মান উন্নয়ন, শিক্ষা-সম্পৃক্ততা ও জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি সম্ভব? সংগীত, নৃত্য, নাটক প্রভৃতি সব বিভাগে এই গুণগ্রাহিতা এবং বাইরের শিল্পীদের সঙ্গে সমন্বয় রয়েছে। ফলে এগুলোর মান ও জনপ্রিয়তা বেড়েছে অনেক। কিন্তু টিভি বিতর্ক বিভাগ এটি করে না। ফলে বিতর্কশৈলীর ক্ষেত্রে সত্তরের দশকের এক বৃত্তেই আমরা আবর্তিত হচ্ছি।

৪. নতুন মডেলের অভাব :
সবকিছুর মূলে রয়েছে বিতর্কের মৌলিক কাঠামো তথা পদ্ধতির প্রশ্নটি। এক ধরনের পদ্ধতি মানে মান্ধাতার অন্তরীণ। এতে যথার্থ যুক্তিবাদী বিতার্কিক সৃষ্টির চেষ্টা অর্জিত হয় না। দোষ তোতা পাখিদের নয়, পদ্ধতির। আজ দুই দশক ধরে একই পদ্ধতির বিতর্ক দেখে মনে হচ্ছে, এর চেয়ে ভালো পদ্ধতি বোধ হয় সৃষ্টি হয়নি।
বিতর্কের মূল লক্ষ্য ১. উদ্বুদ্ধকরণ, ২. যুক্তিবাদিতা, ৩. সৃজনশীলতা, ৪. প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব প্রভৃতি ক্ষমতার উন্নয়ন। কিন্তু এক ধরনের সনাতনী পদ্ধতিতে এগুলোর পূর্ণ সুফল পাওয়া যায় না। প্রয়োজন বিতর্কের ওপর বিভিন্ন মডেলের প্রয়োগ।
বিতর্কের মূল দক্ষতা হচ্ছে মুক্তিখণ্ডনে, অথচ প্রথম বক্তার সে সুযোগ কোথায়? আসুন, আমরা এমন পদ্ধতির কথা ভাবি, যেখানে প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব উৎসাহিত হবে। তাৎক্ষণিক যুক্তিবাদিতা প্রসারিত হবে, সৃজনশীলতায় উদ্বুদ্ধকরণ সমাদৃত হবে এবং গোলটেবিল বিতর্কের মতো প্রত্যেকেই প্রত্যেককে খণ্ডনে সমর্থ হবে। এ ক্ষেত্রে সংসদীয় পদ্ধতি শ্রেয়তর।
তা ছাড়া এ উদ্দেশ্য যথেষ্ট পূরণ করতে পারে বর্তমানে দেশের প্রথম সারির দু-একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরীক্ষিত পদ্ধতির পুঞ্জ মডেল পরীক্ষা-নিরীক্ষা, পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সৃজনশীলতা ও বহির্বিশ্বে বিতর্কের নতুন নতুন শৈলী প্রভৃতির দিকে নজর রেখে এর উন্নয়নসাধন করতে হবে। সৃজনশীল আরও অনেক মডেল রয়েছে, যেমন ১. জাতিসংঘ মডেল, ২ নাট্য মডেল, ৩. ত্রিমাত্রিক মডেল, ৪ পুঞ্জ মডেল, ৫ বন্ধু মডেল, ৬. প্রাক-নির্বাচনী মডেল, ৭. পরম্পরা মডেল ও ৮ পরিস্থিতি মডেল প্রভৃতি।
এত কিছুকে অন্ধভাবে নির্বাসিত করে স্কুল পর্যায়ে ও উচ্চতর পর্যায়ের এই উভয় বিতর্কে শুধু সনাতনী মডেল কামড়ে ধরে বসে থাকা এক অনুর্বর মৌলবাদ বটে। এভাবে বিতর্ক একঘেয়ে হয়ে যায়, জনপ্রিয়তা, জনগ্রাহ্যতা কমে যায় এবং শিল্প হিসেবে বিতর্ক বহুমুখিতায় বিকশিত হতে পারে না। অতএব, পদ্ধতির পরিবর্তন আবশ্যক।
৫. বিচারকমণ্ডলী নির্বাচন :
অনেক সময়েই বিতর্কের রায় সম্পর্কে অভিযোগ পাওয়া যায়। অনেক সাধারণ দর্শক রায় শোনার পর নিজের বুকে হাত দিয়ে অনুভব করেন, তাঁর নিজস্ব ন্যূনতম বিবেকবুদ্ধি লুপ্ত হলো কি না। কিন্তু যে প্রশ্নটি তার পরপরই মানুষ করে বসেন বা জানতে চান সেটি হলো, “বিচারকমণ্ডলীতে কারা আছেন?’ বলা বাহুল্য, তৃতীয় প্রশ্নটি হচ্ছে, ‘আসলে কারা থাকার যোগ্য?’
টিভি বিতর্কের বিচারকমণ্ডলীতে যারা আছেন, তাদের প্রত্যেকেই সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তি। আমরা তাঁদের নিজ নিজ গুণের প্রতি শ্রদ্ধাশীল কিন্তু পদার্থে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক সালামকে যদি রবীন্দ্রসংগীতের বিচারক করা হয়, কিংবা সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী রবীন্দ্রনাথকে যদি মল্লযুদ্ধের বিচারক করা হয়, কিংবা বিশ্ববিখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলীকে যদি নাট্যকলার বিচারক করা হয়, তাহলে কি সেটাকে কেউ সুস্থ বিচারপদ্ধতি হিসেবে মেনে নিতে পারেন? তার বিরুদ্ধে অসন্তোষ কি অসংগত? এ ক্ষেত্রে তাঁদের রায় সঠিক হলেও তা মেনে নেওয়া যায় না, উচিত নয়।
এর জবাবে টিভি বিতর্ক বিভাগ হয়তো বলবে – যারা বর্তমানে বিচারকমণ্ডলীতে আছেন, তাঁদের বিতর্কের অভিজ্ঞতা আছে। কথাটা সর্বাংশে ঠিক নয়। আর ঠিক হলেও এটা প্রতিযোগিতামূলক মাপকাঠি হতে পারে না। শুধু টুকটাক বিতর্ক অভিজ্ঞতার কথাই যদি ধরা হয়, তাহলে জনসংখ্যার প্রায় এক-দশমাংশ মানুষ পাওয়া যাবে, যাঁদের সবারই কমবেশি টুকটাক বিতর্ক বা ঝগড়ার অভিজ্ঞতা আছে। এই মাপকাঠিতে টিভি বিতর্কের বিচারকমণ্ডলীতে প্রায় দেড় কোটি বিচারক থাকা উচিত।
মাপকাঠি বড় দুর্বল। তবু দুঃখের বিষয় যে, এই বিচারকমণ্ডলীর বাইরে অনেক উজ্জ্বল বিতার্কিক, বিতর্ক-চিন্তক, এমনকি বিভিন্ন সময়ে জাতীয় পর্যায়ে বা টিভির শ্রেষ্ঠ বক্তারা আছেন, যারা আলোচিত কিন্তু টিভি কর্তৃক নির্বাসিত। তাদের অযোগ্যতা কোথায় জানি না। নাটক, নৃত্য ও সংগীতে যে মাপকাঠিতে বিচারকমণ্ডলী স্থির করা হয়, তার ন্যূনতমও বিতর্কের বিচারকমণ্ডলীতে মানা হয় না ।
টিভির অন্য যেকোনো মাধ্যমের চেয়ে বিতর্ক মাধ্যমে নৈরাজ্য বেশি, বিশেষত বিচারক নির্বাচনে। দেশে বিচারকের কি এতই আকাল? বিতর্ক কি এতই অনাথ মাধ্যম? এটি যদি সর্বাংশেই একটি প্রতিযোগিতামূলক মাধ্যম হয়, তাহলে বিচারকও মনোনীত হোক প্রতিযোগিতামূলক দৃষ্টিভঙ্গিতে ।
৬. কর্মশালার অভাব :
দেশের সর্বাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ এই জাতীয় অনুষ্ঠানকে অবশ্যই সর্বাধিক শিক্ষামূলক, গণমুখী ও জবাবদিহিমূলক করতে হবে। অন্যথায় টেলিভিশনে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে। সরকার যদি গণমাধ্যমকে গণমুখী ও আরও শিক্ষামূলক করে তুলতে সত্যিই অঙ্গীকারবদ্ধ হয়, তাহলে টিভি বিতর্ক বিভাগকে আরও গণমুখী, জবাবদিহিমূলক, গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক দল ও মতনিরপেক্ষ হতে হবে। এখন সারা দেশে রয়েছে বিতর্কের অসংখ্য সংগঠন। বিটিভি ইচ্ছা করলে তাদের সঙ্গে মতামত বিনিময় করতে পারে, কর্মশালা বা সেমিনারের আয়োজন করতে পারে।
তবে সবার আগে সৃজনশীলতা ও অধিক যুক্তিবাদিতার স্বার্থে বিতর্কপদ্ধতির পরিবর্তন না করলে, অন্ধ দৈত্যের মতো সেন্সর প্রথায় মুক্তচিন্তার কণ্ঠরোধ করলে, প্রতিযোগিতামূলকভাবে বিষয়বস্তুর মান উন্নত না করলে এবং উজ্জ্বলতম অতীত, বিতর্ক অভিজ্ঞতা বা বিতর্ক অবদানের ভিত্তিতে ক্ষমতা বা দলীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে বিচারকমণ্ডলী পুনর্গঠন না করলে বিতর্কের মান উন্নয়ন সম্ভব নয়। শুধু মানের প্রশ্নই নয়, প্রকৃত উদ্দেশ্যও হবে সুদূরপরাহত। বিতর্ক আজও যেন মান্ধাতার অন্তরীণে এক সামন্ত কয়েদি। প্রজ্ঞার প্রসার ও যুক্তিবাদের বিকাশের এ শিল্পকে পরিচালিত করতে হবে।
