আজকে আমরা আলোচনা করবো বিতর্কের আত্মদ্বন্দ্ব মডেল

বিতর্কের আত্মদ্বন্দ্ব মডেল
আত্মমন্থনে যুক্তিচর্চার পথ
বিতর্কের আত্মদ্বন্দ্ব মডেলকে (Self Dialectic Model) ঠিক একক বিতর্ক বললে ভুল হবে না। তবে কম হবে। বারোয়ারি বিতর্কও একক। কিন্তু আত্মদ্বন্দ্বী মডেলের তর্কচর্চা ঠিক একক অভিনয়ের মতো একজনের কথা নয়। এ যেন এক মুখে বহু কথার সমাহার। ক্ষণেই বৃষ্টি ক্ষণেই রোদ।
‘সলো ফাইট’ নামে একধরনের তাস খেলা আছে, যেখানে একজন খেলোয়াড়ই দু-তিনজন সেজে খেলে। একক বিতর্কও অনেকটা সে রকম। এখানে বক্তা কোনো বিষয়ের পক্ষে ও বিপক্ষে দুই বা তিন মিনিটের পালাক্রমে বলে যাবেন টানা বিশ মিনিট। প্রথমে যুক্তি দেবেন। সেটা আবার নিজেই খণ্ডন করবেন। সময়রক্ষক শুধু দুই বা তিন মিনিট পরপর বেল বাজিয়ে যাবেন এবং বক্তা তাঁর পক্ষ পরিবর্তন করবেন। ফলাফলে ঘোষিত হবে, বক্তার গৃহীত কোন পক্ষ জয়ী হলো ।
এতে বিতার্কিকের আত্মবিশ্লেষণক্ষমতা বাড়ে এবং বিষয়বস্তুর যেকোনো দিকে বলার সাহস বাড়ে। এই আত্মদ্বান্দ্বিক বিতর্ক কঠিন হলেও উপকারী। রসিকতা করে কেউ একে একের ভেতর দুই বললেও বারণ করা যাবে না। আত্মদ্বন্দ্ব ও আত্মবিশ্লেষণের মাধ্যমেই একটি সুদৃঢ় বিশ্বাস বক্তার অন্তরের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হবে। এটি এক ব্যক্তির অনুষ্ঠান বলে একজনই সবার ভূমিকায় কথা বলবেন।
ধরা যাক বিষয়বস্তু সব মানুষকেই কোনো না কোনো মূল্যে কেনা যায়। এ ক্ষেত্রে বক্তা প্রথমে এসে উপস্থাপক সেজে বিষয়টি পেশ করে সভাপতির হাতে দায়িত্ব অর্পণ করবেন। এবার সভাপতির মতো নিরপেক্ষ গভীর কণ্ঠে বক্তা জানাবেন যে এ বিষয়ের পক্ষে বলছে ‘দীপ্ত’ ও বিপক্ষে বলছে ‘অনন্ত’। অন্য কোনো নামও হতে পারে। সহজ হয় যদি এ দুজনের নাম সরাসরি ‘পক্ষ ও ‘বিপক্ষ’ রাখা যায়। শুরু করবে পক্ষ।

পক্ষ :
পৃথিবীতে সব মানুষেরই একটা মূল্য আছে—কি ধনী কি দরিদ্র কি মানী কি ক্ষমতাশালী সবাইকে কোনো না কোনো মূল্যে কেনা যায়। ইন্দোনেশিয়ার শাসক সুহার্তো বলেছিলেন, ‘এভরি ম্যান হ্যাজ এ প্রাইস’। এভাবে তিনি তাঁর বিরুদ্ধে যাওয়া রাজনীতিক, সাহিত্যিক, শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীকে বিভিন্ন টাকার অঙ্কে বশ করে রাখতেন কিংবা পক্ষে টেনে নিতেন।
বিপক্ষ :
পক্ষের বক্তার সঙ্গে আমি অনেকটা একমত হলেও বিষয়বস্তুর আসল অংশটুকুতেই দ্বিমত পোষণ করছি। এটি হচ্ছে ‘সব মানুষকে’ শব্দদুটো। পক্ষ ‘সব’ শব্দটা জুড়ে দিয়ে পৃথিবীর তাবৎ জ্ঞানী গুণী ও নীতিনিষ্ঠ সকল মানুষকে বিপণনযোগ্য প্রাণীর পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। মহাভারতের কুন্তীদেবী মহাবীর কর্ণের কাছে ধরনা দিয়েছিলেন যেন তিনি কৌরবকুল ত্যাগ করে পাণ্ডবপক্ষে যুদ্ধ করেন। রবীন্দ্রনাথের কথায় কর্ণের উত্তর ছিল, ‘জয়লোভে যশলোভে রাজ্যলোভে অয়ি/ বীরের সদগতি হতে ভ্রষ্ট নাহি হই।’ আধুনিক যুগে অনেক কর্ণ আমাদের চোখের অগোচরে রয়েছেন, যাদের আমরা চিনি না। তারা ন্যায়ের প্রশ্নে জীবন দিতেও প্রস্তুত। কিন্তু পণ্যের মতো তাদের কেনা যায় না।
পক্ষ :
বিপক্ষ মহাকাব্যিকতার অবতারণা করে বিষয়টিকে বিভ্রান্ত করছেন। তিনি ভুলে যাচ্ছেন যে কর্ণেরও একটা মূল্য ছিল, যা দুর্যোধন তাকে দিতে পেরেছিলেন। অঙ্গ নামে একটি রাজ্য ও তার ভূপতি হবার সম্মান। সে মূল্যের জোরে কর্ণ কৌরবকুলের অন্যতম সেনাপতি। মূল্য সব সময় টাকার অঙ্কে হতে হবে এমন কথা নেই। সেটা পদ-পদবি বা সম্মানও হতে পারে।
বিপক্ষ :
পক্ষের বক্তা মূল্য শব্দটিকে অর্থনৈতিক মূল্যের মধ্যে না রেখে জগতের তাবৎ পদার্থ এবং শেষ পর্যন্ত অতীন্দ্রিয় অনুভূতিতে পরিণত করেছেন । ইন্দোনেশিয়ার যে উদাহরণ তিনি টেনেছেন সেখানে সামরিক জান্তা সুহার্তো আর্থিক মূল্যই বুঝিয়েছেন। ব্রিটিশ এক চিন্তাবিদ মন্তব্য করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ একাই একটি কারণ, যার জন্য ভারত স্বাধীন হওয়া উচিত। ব্রিটিশরা বিব্রত ছিল রবীন্দ্রের স্বাধীনতাকামী কাব্যশক্তির কারণে। কই, ব্রিটিশের নাইটহুড তো রবীন্দ্রনাথকে কিনতে পারেনি। পাক শাসকের আপসকামী প্রস্তাব বঙ্গবন্ধুকে টলাতে পারেনি। তাকে কোনো মূল্যেই কেনা যায়নি। (এভাবে চলবে…)
আত্মস্বান্দ্বিক এই বিতর্কপথ আত্মবিশ্লেষণে বক্তাকে সমৃদ্ধ করবে। বাড়াবে চিন্তার ভারসাম্য। দর্শকের মাঝে সৃষ্টি করবে বিস্ময়, আনন্দ ও আত্মজিজ্ঞাসার নতুন অনুশীলন। আশা করব বিতার্কিকেরা আত্মদ্বন্দ্বী মডেলের পরীক্ষামূলক চর্চা বাড়িয়ে এর নিয়মাবলির উন্নয়ন ঘটাবেন। তবে সামনে রাখবে জ্ঞানমন্থনের লক্ষ্য। সমুদ্র মন্থনের মতো আত্মদ্বন্দ্ব বিতর্কে উঠবে বিষ, উঠবে অমৃত ও সার্থক হবে সৃষ্টিমুখী আত্মমন্থন।
